খাবার নিয়ে ক্ষোভের কারণ
চীনে খাবার সম্পর্কিত কেলেঙ্কারি সব সময়ই মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া জাগায়। দেশের সমৃদ্ধ রন্ধনঐতিহ্যের প্রতি গর্বই এখানে প্রধান কারণ। তবে বিষয়টি কেবল স্বাদের নয়, বরং নিরাপত্তা, কর্পোরেট দায়িত্বশীলতা এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে। প্রশ্ন হলো—টেবিলে যে খাবার রাখা হচ্ছে, তা কি সত্যিই ভরসাযোগ্য?
সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি নতুন এক দিক উন্মোচন করেছে। এটি খাবারের নিরাপত্তা নয়, বরং খাবারের মান এবং রান্নার সংজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু জনপ্রিয় ফাস্ট-ক্যাজুয়াল রেস্তোরাঁ চেইন ‘শি-বেই’, যারা নিজেদের খাবারকে সতেজ ও পরিবারবান্ধব হিসেবে প্রচার করত। কিন্তু জানা গেল, তারা অনেক খাবারই প্রস্তুতকৃত বা ফ্রোজেন উপাদান দিয়ে বানায়, যেগুলো আগে থেকেই কেন্দ্রীয় রান্নাঘরে প্রস্তুত থাকে।
কীভাবে শুরু হলো বিতর্ক
ঘটনার সূত্রপাত হয় উদ্যোক্তা ও প্রভাবশালী ব্লগার লুও ইয়ংহাও-এর এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট থেকে। তাঁর মন্তব্য ছিল—“প্রায় সব খাবারই আগে থেকে বানানো, অথচ দাম এত বেশি। বিরক্তিকর।” তাঁর ১৪ লাখ অনুসারী থাকায় বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শি-বেই শুধু সমালোচনা মানেইনি, বরং মানহানির অভিযোগে মামলা করার হুমকি দিয়েছিল। এরপর তারা নিজেদের রান্নাঘর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে। সেখানে দেখা যায় দুই বছরের মেয়াদি ফ্রোজেন ব্রকোলি, বুইলিয়ন দিয়ে তৈরি দামি স্যুপ, আর প্রশিক্ষণবিহীন কর্মীদের হাতেই খাবার প্রস্তুত হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবার যারা শি-বেই-কে বিশেষ দিনের জন্য নির্ভরযোগ্য জায়গা মনে করত, তাদের কাছে এটি ছিল এক ধরনের প্রতারণা।
ভণ্ডামির অভিযোগ
শি-বেই প্রায় ৪০০ শাখা এবং ৬০০ কোটি ইউয়ান আয় নিয়ে বড় চেইন হিসেবে পরিচিত। তারা কাঠের সাজসজ্জা, লাল-সাদা টেবিলক্লথ এবং ভিডিওচিত্রে রন্ধনশিল্পীদের দেখিয়ে সতেজতার ছদ্মবেশ তৈরি করত। অথচ বাস্তবে দেখা গেল প্রি-মেড খাবার পরিবেশন।
বেইজিংয়ের একটি শাখায় বিতর্কের কয়েকদিন পর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গ্রাহক দেখা গেল। কেউ কেউ কৌতূহলবশত গিয়েছিল, আবার কেউ বলল—“প্রি-মেড খাবার সুবিধাজনক বটে, তবে তা আগে থেকে জানানো উচিত।”
প্রস্তুতকৃত খাবারের বাজার
শি-বেই-এর এই সংকট প্রি-মেড খাবারের প্রবণতা থামাতে পারবে না। চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বল্প খরচে ভালো খাবার চায়। কেন্দ্রীয় রান্নাঘর থেকে প্রস্তুতকৃত খাবার সেই চাহিদা পূরণে কার্যকর। মাত্র ১৫ বছরে দেশটি গ্রামীণ থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ নগরকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ফলে সবার কাছে উচ্চমানের রন্ধনশিল্পীর রান্না পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়।
শেফ হওয়ার পেশা এখনো কঠিন—দীর্ঘ সময় কাজ, কম বেতন আর ধোঁয়াভরা রান্নাঘর। তাই কেন্দ্রীকৃত রান্না অনেক রেস্তোরাঁর জন্য যৌক্তিক সমাধান। ২০২২ সালে প্রি-মেড খাবারের বাজারে আয় ছিল ৪০০০ কোটি ইউয়ান, আর আগামী বছরে তা ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান ছাড়াবে বলে ধারণা। উন্নত কোল্ড-চেইন ব্যবস্থা এটিকে আরও গতিশীল করেছে।
সরকার গত বছর প্রথমবারের মতো প্রি-মেড খাবারের জন্য মান নির্ধারণ করে। তবে তাতে অসঙ্গতি ছিল—কেন্দ্রীয় রান্নাঘরে তৈরি বা প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা খাবারকেও অনেকে নিয়মের বাইরে বলে দাবি করতে পারে।
দুই স্তরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি
সাংস্কৃতিক বিশ্লেষক জিয়াং দংলিয়াং মনে করেন, ভবিষ্যতে চীনের রেস্তোরাঁ শিল্প দুই স্তরে বিভক্ত হবে। প্রথম স্তরে থাকবে শি-বেইয়ের মতো চেইন, যারা নির্ভরযোগ্যভাবে প্রি-মেড খাবার গরম করে পরিবেশন করবে। আর দ্বিতীয় স্তরে থাকবে বিশেষায়িত উচ্চমানের রেস্তোরাঁ, যেখানে বিখ্যাত শেফরা সরাসরি রান্না করবেন এবং নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন।
সুযোগ ও হতাশা
প্রি-মেড খাবার অনেক দিক থেকে সমান সুযোগ তৈরি করছে। যেমন জটিল ফুজিয়ানিজ় সি-ফুড স্ট্যু ‘বুদ্ধা জাম্পস ওভার দ্য ওয়াল’, যা আগে শুধু বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় আগেভাগে অর্ডার করে পাওয়া যেত, এখন সাধারণ চেইন রেস্তোরাঁয়ও পাওয়া যাচ্ছে। স্বাদে হয়তো পুরোপুরি সমান নয়, কিন্তু কাছাকাছি।
তবে চীনের খাবারপ্রেমী মানুষের কাছে এ এক হতাশা—যে খাবার তারা নিয়মিত কিনতে পারে, সেটি মূলত ভ্যাকুয়ামপ্যাকেট থেকে বের করে গরম করা। আর এই বাস্তবতাই পুরো বিতর্ককে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।