সোনার উল্লম্ফনে সাধারণ মানুষের চাপ
বাংলাদেশে সোনার দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শুধু গহনার দোকান বা বিনিয়োগকারীদের সমস্যায় ফেলেনি, এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়ও। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি—একদিকে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, অন্যদিকে সামাজিক রীতিনীতি পালনে সোনার অপরিহার্যতা তাদের অস্বস্তিতে ফেলছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, “সোনার দামের এই উল্লম্ফন শুধু বাজারের বিষয় নয়, এটি এখন সামাজিক সংকটও। সঞ্চয়ের প্রবণতা কমছে, আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে সামাজিক রীতিনীতি মানতে গিয়ে ঋণের বোঝা নিতে হচ্ছে।”
পারিবারিক অনুষ্ঠান ও বিয়ের খরচে বেড়েছে সংকট
বাংলাদেশে বিয়েতে সোনার অলংকার এখনো সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। কনের গয়না না থাকলে আত্মীয়-স্বজনের চোখে পরিবারকে ছোট করে দেখা হয়। কিন্তু এখন এক জোড়া কানের দুল বা আংটির দাম ১ লাখ টাকা ছুঁইছুঁই। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে হয় ঋণ নিতে হচ্ছে, নয়তো পুরোনো গয়না গলিয়ে কাজে লাগাতে হচ্ছে। এতে করে পরিবারের আর্থিক স্থিতিশীলতা আরও দুর্বল হচ্ছে।
তান্তিবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ হালদার বলেন, “২০০০ সালে ভরি প্রতি সোনার দাম ছিল ১০ হাজার টাকার নিচে। কিন্তু এখন তা প্রায় দুই লাখ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে সাধারণ মানুষ আর সোনার গয়নার দিকে ফিরবেই না।”
বিনিয়োগের বাজারে অনিশ্চয়তা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সোনা শুধু অলংকার নয়, বরং নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবেও জনপ্রিয়। কিন্তু যখন দাম লাগামছাড়া বাড়ে, তখন নতুন বিনিয়োগকারীরা দূরে সরে যান। একই সঙ্গে যাদের কাছে আগে থেকে সোনা আছে, তারা বিক্রি করে নগদ অর্থ তুলে নিচ্ছেন। এতে একদিকে সোনার প্রকৃত চাহিদা কমছে, অন্যদিকে সঞ্চয়ের ধারা বদলে যাচ্ছে।
বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে দাম সমন্বয় করি। যুদ্ধ, ডলারের ওঠানামা ও বৈশ্বিক চাহিদা—সব মিলিয়েই দাম বাড়ছে। এতে দেশের ক্রেতারা বিপাকে পড়ছেন, আর ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছি।”
মুদ্রাস্ফীতি ও সোনার দামের দ্বিমুখী প্রভাব
বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পরিবহন খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সোনার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। মধ্যবিত্তরা যে সামান্য সঞ্চয় করেন, তা দিয়ে সোনা কেনা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর ফলে সঞ্চয় নিরাপদ করার একটি বড় মাধ্যম হাতছাড়া হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন সুলতানা বলেন, “বাংলাদেশে সোনার দাম শুধু গয়নার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপেরও একটি সূচক। যখন সোনা এভাবে বাড়ে, তখন বুঝতে হবে অর্থনীতির ভেতরে চাপ জমছে।”
সামাজিক অসাম্য আরও বাড়ছে
সোনার দামের উল্লম্ফনে সমাজে ধনী-গরিব বিভাজন আরও প্রকট হচ্ছে। ধনীরা এখনও সহজে সোনা কিনতে পারলেও, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্ররা সামাজিক অনুষ্ঠানে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। আগে যেখানে ছোটখাটো সোনার গয়না দেওয়া ছিল সবার সাধ্যের মধ্যে, এখন তা অনেকের জন্য অসম্ভব। এর ফলে বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধনও কখনো কখনো ভেঙে যাচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন, যিনি সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বলেন, “আমি নতুন কিছু কিনতে পারিনি, পুরোনো গয়নাতেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আত্মীয়দের চোখে আমরা যেন ছোট হয়ে গেলাম।”
বৈদেশিক মুদ্রা ও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
বিশ্ববাজারে ডলারের মান কমা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীনের সোনার মজুত বৃদ্ধির মতো বৈশ্বিক কারণগুলো সরাসরি বাংলাদেশে প্রভাব ফেলছে। দেশের স্বর্ণকাররা বলছেন, দাম বাড়লে বিক্রি কমে, আর বিক্রি কমলে পুরো বাজার স্থবির হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে শ্রমজীবী শ্রেণির ওপরও—যারা সরাসরি এই ব্যবসায় যুক্ত, সেই প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের জীবিকা সংকটে পড়ে।
মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
যদি সোনার দাম এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে মধ্যবিত্তরা আর্থিক ও সামাজিক দুই দিক দিয়েই চাপে পড়বেন। তাদের জন্য বিয়ে, উৎসব কিংবা সঞ্চয়—সবই আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি সমাজে হতাশা, সামাজিক চাপ এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সোনা একদিকে বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। কিন্তু লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি মধ্যবিত্ত জীবনে এক গভীর সংকট তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের এখন শুধু বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি নয়, সামাজিক চাপের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে সোনার বাজারের এই অস্থিরতা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।