গত এক বছরে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে—বিশেষ করে শাকসবজি, মুরগি, মাছ ও ডিম—দামের লাগাতার বৃদ্ধির ধারা দেখা যাচ্ছে। সংবাদ ও বাজার পর্যবেক্ষণে পাওয়া তথ্য বলছে, শুধু খাদ্যগুণগত দিকেই নয়, ভোক্তাদের রুচি ও পুষ্টি বিষয়েও প্রভাব পড়ছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর জন্য এই চাপ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
বাজার দামের চিত্র
শাকসবজি
- অধিকাংশ শাকসবজি এখন প্রতি কেজি ৮০–১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে—যেমন বেগুন, ঝিঁগা, করলা ইত্যাদি।
- টমেটোর দাম সম্প্রতি বড় আকারে বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি কেজি ১৬০–১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
- শিম (সীম) প্রতি কেজি ২০০ টাকায় পৌঁছেছে।
- বেলাশাক, পুঁইশাক ও অন্যান্য পাতা জাতীয় সবজি একটি বাণ্ডেল ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ বা ততোধিক।
- মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, শস্য উৎপাদনের বিঘ্ন, সরবরাহ কম হওয়া, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি।
- উদাহরণস্বরূপ, পটল এখন ৬০–৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে, যা এক বছর আগে অনেক কম ছিল।
- কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সবজি সমষ্টিগতভাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৬ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মুরগি ও ডিম
- ব্রয়লার মুরগি খুচরা দামে এখন প্রতি কেজি ১৭০–১৮০ টাকা।
- সোনালি মুরগির দাম প্রতি কেজি ৩১০–৩২০ টাকা।
- ডিমের ক্ষেত্রে, দেশি লাল ডিম এখন প্রতি ডজন ১৪০–১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ১০ দিন আগে ছিল ১২০–১২৫ টাকা।
- সাদা ডিম প্রতি ডজন ১৩০–১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
- কিছু অঞ্চলে লাল ডিম ১২৫–১৩০ টাকায় এবং সাদা ডিম ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছ
- মাছের বাজারেও বড় ধরনের দামের ওঠানামা রয়েছে।
- রুই মাছ প্রতি কেজি ৩৮০–৪২০ টাকা।
- কাটলা মাছ প্রতি কেজি ৪০০–৪৮০ টাকা।
- শিং ও মাগুর মাছের দাম প্রতি কেজি ৫০০–৬০০ টাকা।
- পোয়া মাছ প্রতি কেজি ৫৫০–৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
- বড় মাছ যেমন বোয়াল ৮০০–১২০০ টাকা এবং আড় মাছ ১০০০ টাকা প্রতি কেজি।
- মাঝারি আকারের ইলিশ (এক কেজির নিচে) বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ টাকা, আর বড় ইলিশ ২০০০–২৫০০ টাকা পর্যন্ত।
কেন দাম বাড়ছে?
১. আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বিঘ্ন
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বন্যা শস্য ও মাছ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটিয়ে সরবরাহ কমাচ্ছে। বিশেষ করে শাকসবজি ক্ষেত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছের ক্ষেত্রেও নদী ও জলাভূমির পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব পড়ছে।
২. উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি
মুরগি ও ডিম উৎপাদনে ব্যবহৃত খাদ্য (চাল, ভুট্টা, সয়াবিন, ময়দা) আন্তর্জাতিক বাজারে দামে বেড়েছে, ফলে খরচও বেড়েছে। এর সঙ্গে পরিবহন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধিও যোগ হয়েছে।
৩. সরবরাহ চেইনের সমস্যা
পর্যাপ্ত ট্রাক, বরফ ও সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় অপচয় ও ক্ষতি বাড়ছে। মধ্যবর্তী পাইকার ও বিক্রেতারা বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন। কখনও কখনও অসাধু সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
৪. চাহিদার চাপ
সবজির দাম বাড়লে অনেকে বিকল্প হিসেবে মাছ বা মুরগির দিকে ঝুঁকছেন, আবার মাছের দাম বাড়লে ডিমের চাহিদা বাড়ছে। ফলে একটির ঘাটতি অন্যটির ওপর চাপ ফেলছে।
৫. নীতিগত সীমাবদ্ধতা
সরকার কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করলেও বাজারে তা কার্যকরভাবে বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। আমদানির শুল্ক ও ভর্তুকি নীতিতেও ঘাটতি রয়েছে।
সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব
- খাদ্য বাজেট সংকুচিত হচ্ছে: শাকসবজি, মাছ ও মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলোকে বাধ্য হয়ে কম দামী ও কম পুষ্টিকর খাদ্যে ঝুঁকতে হচ্ছে।
- পুষ্টিহীনতা: শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের জন্য প্রোটিন ও ভিটামিন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
- সামাজিক চাপ: পরিবারের বাজেট সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে ওষুধ, শিক্ষা, বিদ্যুৎ বিলের মতো প্রয়োজনীয় খাতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
- উৎপাদক ও কৃষকদের অনিশ্চয়তা: উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় কৃষক ও মৎস্যজীবীরা সবসময় লাভবান হচ্ছেন না, বরং বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে।
শাকসবজি, মুরগি, মাছ ও ডিম—এই চারটি খাতের দামের ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আবহাওয়া, উৎপাদন খরচ, সরবরাহ চেইন ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা। তাই এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের নীতি, উৎপাদকের দক্ষতা ও ভোক্তার সচেতনতা—তিন পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।