০২:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
সেমিয়ার্কা: কাজাখস্তানের স্তেপে প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগের একটি শহরের খোঁজ এআই বদলে দিচ্ছে আর্থিক খাতের শক্তির সমীকরণ ঢাকায় সবজি–প্রোটিনে আগুন-দাম: নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকার লড়াই চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ৫ সশস্ত্র বাহিনী দিবস শুক্রবার পালিত হবে ডাকসু নেত্রীর বাড়িতে আগুন ও ককটেল বিস্ফোরণ স্টক মার্কেট সপ্তাহ শেষ করল নিম্নমুখী লেনদেনে বোলারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সিরিজ জয়ের পথে বাংলাদেশ আরও চারজনের মৃত্যুতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক কোনো বহিরাগত বা অভ্যন্তরীণ শক্তিকে সুযোগ দেব না: সিএসসি-কে ঢাকার বার্তা

ঢাকা বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল: স্বপ্নের প্রকল্প, বাস্তবায়নে জটিলতা

দেশের আকাশপথে নতুন যুগের প্রতিশ্রুতি

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্প বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক মানের নকশা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যাত্রীসেবার গুণগত মান বৃদ্ধির প্রত্যাশায় ২০১৯ সালে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। লক্ষ্য ছিল—বার্ষিক যাত্রীসেবা ৮ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ২০ মিলিয়নে উন্নীত করা এবং কার্গো পরিবহন ক্ষমতা দ্বিগুণ করে ৫ লাখ টনে নেওয়া।

সরকারি হিসেবে প্রায় ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প শুধু বিমানবন্দরের সক্ষমতা নয়, বরং বৈদেশিক বাণিজ্য, পর্যটন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকাশক্তি হওয়ার কথা।

নির্মাণ পরিকল্পনা ও সুযোগ-সুবিধা

৩য় টার্মিনালের মোট আয়তন প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটার। এখানে থাকছে—

  • অত্যাধুনিক চেক-ইন ও ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম
  • স্বয়ংক্রিয় বোর্ডিং ব্রিজ, এসক্যালেটর, এলিভেটর ও ওয়াকালেটর
  • ভিভিআইপি কমপ্লেক্স, আধুনিক কার্গো টার্মিনাল ও বহুস্তরীয় পার্কিং
  • আগমন ও প্রস্থান ইমিগ্রেশন ডেস্কে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার

প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (ADC), যার অংশীদার মিতসুবিশি, ফুজিতা করপোরেশন ও স্যামসাং সি অ্যান্ড টি কোম্পানি।

নির্মাণ অগ্রগতি: প্রায় শেষউদ্বোধনে বিলম্ব

সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আংশিক উদ্বোধনও হয়েছে। তবে পূর্ণ উদ্বোধনের সময়সীমা বারবার পিছিয়েছে—প্রথমে নির্ধারণ করা হয়েছিল ডিসেম্বর ২০২৪, এখন লক্ষ্য ডিসেম্বর ২০২৫।

বিলম্বের মূল কারণ অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ (O&M) চুক্তি নির্ধারণে জটিলতা। জাপানি এক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে শর্ত নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় চুক্তি এগোয়নি। তারা দোকান ভাড়া, বিজ্ঞাপন, পার্কিং ফি ও নিরাপত্তা চার্জসহ টার্মিনালের রাজস্ব খাতের নিয়ন্ত্রণ চাইছিল, যা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (CAAB) গ্রহণযোগ্য মনে করেনি।

চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক

চুক্তিগত অচলাবস্থা – বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে শর্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকল্পকে স্থবির করেছে।
অতিরিক্ত দাবি – নির্মাণকারী স্যামসাং অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা দাবি করায় অর্থায়ন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি – যন্ত্রপাতি বসানো হলেও ব্যবহার শুরু হয়নি, ফলে অনেকের ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ সংকট – বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) ও মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে অবকাঠামো স্থাপন নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
কর্মীসংকট ও প্রশিক্ষণ – পূর্ণ কার্যক্রম চালু করতে প্রায় ৬ হাজার দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন, যা এখনও নিশ্চিত হয়নি।

সম্ভাবনা: অর্থনীতি ও যাত্রীসেবার রূপান্তর

৩য় টার্মিনাল কার্যকর হলে—

  • বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা তিনগুণ হবে
  • কার্গো হ্যান্ডলিং দ্বিগুণ হয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে
  • যাত্রীসেবায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে আন্তর্জাতিক মান অর্জন হবে
  • বাংলাদেশ আঞ্চলিক এভিয়েশন হাবে পরিণত হওয়ার সুযোগ পাবে

এটি শুধু আকাশপথ নয়, অর্থনীতি ও পর্যটন খাতেও বিপুল ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সুপারিশ ও করণীয়

  • দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অপারেটর চূড়ান্ত করা
  • সরকার ও অপারেটরের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ রাজস্ব শর্ত নির্ধারণ
  • অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও ওয়ারেন্টি সমস্যা দ্রুত সমাধান
  • টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও কর্মী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা
  • স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও ট্রায়াল অপারেশন (Operational Readiness and Airport Transfer – ORAT) সম্পন্ন করা

ঢাকা বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল দেশের জন্য এক স্বপ্নের প্রকল্প। নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হলেও কার্যকর হতে না পারায় প্রকল্পটি এখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়। সময়মতো সিদ্ধান্ত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা না হলে এ স্বপ্নের টার্মিনাল দীর্ঘসূত্রতায় পরিণত হবে।

তবে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এই টার্মিনাল বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে—যা হবে দেশের আকাশপথের এক নতুন যুগের সূচনা।

জনপ্রিয় সংবাদ

সেমিয়ার্কা: কাজাখস্তানের স্তেপে প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগের একটি শহরের খোঁজ

ঢাকা বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল: স্বপ্নের প্রকল্প, বাস্তবায়নে জটিলতা

১১:৪৫:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫

দেশের আকাশপথে নতুন যুগের প্রতিশ্রুতি

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্প বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক মানের নকশা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যাত্রীসেবার গুণগত মান বৃদ্ধির প্রত্যাশায় ২০১৯ সালে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। লক্ষ্য ছিল—বার্ষিক যাত্রীসেবা ৮ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ২০ মিলিয়নে উন্নীত করা এবং কার্গো পরিবহন ক্ষমতা দ্বিগুণ করে ৫ লাখ টনে নেওয়া।

সরকারি হিসেবে প্রায় ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প শুধু বিমানবন্দরের সক্ষমতা নয়, বরং বৈদেশিক বাণিজ্য, পর্যটন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকাশক্তি হওয়ার কথা।

নির্মাণ পরিকল্পনা ও সুযোগ-সুবিধা

৩য় টার্মিনালের মোট আয়তন প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটার। এখানে থাকছে—

  • অত্যাধুনিক চেক-ইন ও ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম
  • স্বয়ংক্রিয় বোর্ডিং ব্রিজ, এসক্যালেটর, এলিভেটর ও ওয়াকালেটর
  • ভিভিআইপি কমপ্লেক্স, আধুনিক কার্গো টার্মিনাল ও বহুস্তরীয় পার্কিং
  • আগমন ও প্রস্থান ইমিগ্রেশন ডেস্কে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার

প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (ADC), যার অংশীদার মিতসুবিশি, ফুজিতা করপোরেশন ও স্যামসাং সি অ্যান্ড টি কোম্পানি।

নির্মাণ অগ্রগতি: প্রায় শেষউদ্বোধনে বিলম্ব

সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আংশিক উদ্বোধনও হয়েছে। তবে পূর্ণ উদ্বোধনের সময়সীমা বারবার পিছিয়েছে—প্রথমে নির্ধারণ করা হয়েছিল ডিসেম্বর ২০২৪, এখন লক্ষ্য ডিসেম্বর ২০২৫।

বিলম্বের মূল কারণ অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ (O&M) চুক্তি নির্ধারণে জটিলতা। জাপানি এক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে শর্ত নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় চুক্তি এগোয়নি। তারা দোকান ভাড়া, বিজ্ঞাপন, পার্কিং ফি ও নিরাপত্তা চার্জসহ টার্মিনালের রাজস্ব খাতের নিয়ন্ত্রণ চাইছিল, যা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (CAAB) গ্রহণযোগ্য মনে করেনি।

চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক

চুক্তিগত অচলাবস্থা – বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে শর্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকল্পকে স্থবির করেছে।
অতিরিক্ত দাবি – নির্মাণকারী স্যামসাং অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রায় হাজার কোটি টাকা দাবি করায় অর্থায়ন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি – যন্ত্রপাতি বসানো হলেও ব্যবহার শুরু হয়নি, ফলে অনেকের ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ সংকট – বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) ও মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে অবকাঠামো স্থাপন নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
কর্মীসংকট ও প্রশিক্ষণ – পূর্ণ কার্যক্রম চালু করতে প্রায় ৬ হাজার দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন, যা এখনও নিশ্চিত হয়নি।

সম্ভাবনা: অর্থনীতি ও যাত্রীসেবার রূপান্তর

৩য় টার্মিনাল কার্যকর হলে—

  • বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা তিনগুণ হবে
  • কার্গো হ্যান্ডলিং দ্বিগুণ হয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে
  • যাত্রীসেবায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে আন্তর্জাতিক মান অর্জন হবে
  • বাংলাদেশ আঞ্চলিক এভিয়েশন হাবে পরিণত হওয়ার সুযোগ পাবে

এটি শুধু আকাশপথ নয়, অর্থনীতি ও পর্যটন খাতেও বিপুল ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সুপারিশ ও করণীয়

  • দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অপারেটর চূড়ান্ত করা
  • সরকার ও অপারেটরের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ রাজস্ব শর্ত নির্ধারণ
  • অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও ওয়ারেন্টি সমস্যা দ্রুত সমাধান
  • টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও কর্মী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা
  • স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও ট্রায়াল অপারেশন (Operational Readiness and Airport Transfer – ORAT) সম্পন্ন করা

ঢাকা বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনাল দেশের জন্য এক স্বপ্নের প্রকল্প। নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হলেও কার্যকর হতে না পারায় প্রকল্পটি এখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়। সময়মতো সিদ্ধান্ত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা না হলে এ স্বপ্নের টার্মিনাল দীর্ঘসূত্রতায় পরিণত হবে।

তবে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এই টার্মিনাল বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে—যা হবে দেশের আকাশপথের এক নতুন যুগের সূচনা।