শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, কিন্তু সমান সুযোগ নয়
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয় শ্রমশক্তি ৭ কোটি ১৭ লাখ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় দুই কোটির বেশি নারী—যা মোট শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ।
গত এক দশকে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে; ২০১৪ সালে যেখানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে তা প্রায় ৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবুও পুরুষদের তুলনায় (৮০-৮৫ শতাংশ) এটি অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ যোগ্য ও কর্মক্ষম অনেক নারী এখনো শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছেন না।
সমান শ্রমেও বৈষম্য—সংখ্যায় প্রমাণ
দেশে আইন রয়েছে—“সমান কাজে সমান মজুরি”। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
- পুরুষ শ্রমিকের মাসিক গড় আয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা।
- নারী শ্রমিক পান মাত্র ১২ হাজার ৬০০ টাকা।
অর্থাৎ নারীরা প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কম আয় করছেন। শহর ও গ্রাম, কৃষি থেকে শুরু করে শিল্প—সবখানেই একই বৈষম্য বিদ্যমান। কৃষি খাতে নারীর শ্রমকে অনেক সময় ‘সহায়ক’ হিসেবে দেখা হয়, ফলে তাঁদের প্রকৃত আয় সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না।
তৈরি পোশাক শিল্প: নারীর বড় অবদান, তবু বৈষম্য অব্যাহত
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কাজ করেন, এর অধিকাংশই নারী। অথচ এখানেও সমান কাজের জন্য নারীরা পুরুষের তুলনায় ২২-৩০ শতাংশ কম বেতন পান।
- একই পদে বছরের পর বছর কাজ করেও নারীরা পদোন্নতির সুযোগ পান না।
- গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যবস্থাপনা বা নেতৃত্বের পদে নারীর উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
উদাহরণস্বরূপ, সাভারের এক কারখানায় রেহানা আক্তার নামের এক শ্রমিক ছয় বছর ধরে একই পদে কাজ করছেন। সামান্য বেতন বৃদ্ধি ছাড়া তিনি কোনো পদোন্নতি পাননি। অথচ তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা একে একে উচ্চপদে পৌঁছে গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংসারের দায়িত্ব, সামাজিক চাপ ও সময়ের সীমাবদ্ধতা নারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মাঠপর্যায়ের শ্রম: প্রতিদিনের বৈষম্য
লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের সীমান্ত এলাকায় হাজারো নারী-পুরুষ পাথর ভাঙার মতো কষ্টকর শ্রমে যুক্ত। কিন্তু মজুরির ক্ষেত্রে পার্থক্য স্পষ্ট:
- পুরুষ শ্রমিক পান প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা।
- নারী শ্রমিক পান মাত্র ৪০০ টাকা।
এই দৈনিক পার্থক্য মাস শেষে বিশাল অঙ্কে দাঁড়ায়। একই শ্রম দিয়ে নারী কেবল লিঙ্গের কারণে কম আয় করছেন।
উচ্চশিক্ষিত নারীদের ক্ষেত্রেও বৈষম্য
কেবল নিম্নআয়ের ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষিত নারীরাও পিছিয়ে।
- স্নাতক বা এর বেশি ডিগ্রিধারী নারীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৯ শতাংশ।
- একই যোগ্যতার পুরুষদের বেকারত্ব মাত্র ১২ শতাংশ।
এমনকি যারা চাকরি পাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও বেতন ও পদোন্নতিতে বৈষম্য রয়ে যাচ্ছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর নেতৃত্বস্থানীয় পদে সংখ্যা এখনো নগণ্য।
অদৃশ্য যত্নশ্রম: অর্থনীতির অগণিত অবদান
নারীরা প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টা ৪০ মিনিট গৃহস্থালির কাজ ও যত্নশ্রমে ব্যয় করেন। পুরুষরা একই কাজে সময় দেন মাত্র ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট।
‘অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নশ্রম জরিপ ২০২৪’ বলছে, এই কাজের অর্থনৈতিক মূল্য হিসাব করলে দেশের জিডিপির এক-চতুর্থাংশ নারীর অবদান থেকেই আসত। অথচ এই শ্রমের কোনো পারিশ্রমিক বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই।
আন্তর্জাতিক তুলনা: বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই নারীর অংশগ্রহণ কম। বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বেড়েছে, তবে কর্মসংস্থান এখনও অনিশ্চিত, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এখানে মজুরি ও অধিকার রক্ষার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ভারত, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপালের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ কিছুটা ভালো হলেও বৈষম্যের মাত্রা প্রায় একই।
বিশেষজ্ঞ মতামত
- ড. ফাহমিদা খাতুন (সিপিডি): নারীর অবৈতনিক গৃহশ্রম সরকারি হিসাব ও জিডিপিতে ধরা হয় না। অথচ এর মূল্য বিশাল। এই শ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া গেলে বাজেট পরিকল্পনায় বাস্তব চিত্র ফুটে উঠবে।
- শারমীন এস মুরশিদ (নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা): নারীর শ্রমকে সম্মান না দিলে সমান মজুরির আইন কার্যকর হবে না। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি প্রণয়ন জরুরি।
সমাধানের পথ কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর প্রকৃত অবদান প্রতিফলিত করতে হলে—
সমান মজুরি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
পদোন্নতিতে সমান সুযোগ দিতে হবে।
অবৈতনিক গৃহশ্রমের স্বীকৃতি দিতে হবে জাতীয় নীতি ও বাজেটে।
সমাজে লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষা ও প্রচারণার মাধ্যমে।
নারীরা দেশের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখলেও এখনো মজুরি, পদোন্নতি, স্বীকৃতি—সবক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। তৈরি পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে কৃষি ও শিক্ষা খাত—প্রতিটি স্তরে একই চিত্র।
যদি অবৈতনিক গৃহশ্রম ও সমান মজুরির নিশ্চয়তা দেওয়া যায়, তবে নারীর প্রকৃত অবদান জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হবে। শুধু তাই নয়, নারীর ক্ষমতায়ন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও নতুন গতি যোগ করবে।