০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

নরওয়ের ভ্রমণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘কুইক লাঞ্চ’

ভ্রমণের সঙ্গী ‘কুইক লাঞ্চ’

নরওয়ের মানুষের কাছে আউটডোর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বিশেষ চকোলেট বার – কুইক লাঞ্চ। স্থানীয়রা একে বলে ‘ট্রিপ চকোলেট’। পাহাড়ে ওঠা, স্কি করা কিংবা বনে ঘোরার সময় প্রায় সবাই সঙ্গে রাখে এই চার ফালি ওয়েফার। প্রতিবছর প্রায় ৬ কোটি বার তৈরি হয়, অর্থাৎ প্রতি নরওয়েজীয়ের জন্য গড়ে ১১টি। এটি কেবল একটি মিষ্টি নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।

Ola Heggem Kvikk Lunsj has long been called a KitKat knockoff (Credit: Ola Heggem)

জন্ম কাহিনি: ব্যর্থ এক ভ্রমণ থেকে

১৯৩৭ সালে কুইক লাঞ্চ বাজারে আসে। কিন্তু এর গল্প শুরু হয়েছিল ১৮৯০-এর দশকে, যখন ব্যবসায়ী জোহান থ্রোনে হোলস্ট জার্মান এক সহকর্মীকে নিয়ে অসলোর বাইরে বনে পথ হারান। ক্ষুধার্ত অবস্থায় জার্মান সহকর্মী বলেছিলেন, যদি চকোলেট থাকত, যাত্রা অনেক সহজ হতো। দুই বছর পর হোলস্ট ছোট একটি চকোলেট কারখানা ‘ফ্রেইয়া’ কিনে নেন এবং কয়েক দশকের মধ্যে সেটিকে জাতীয় ব্র্যান্ডে পরিণত করেন।

নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেন ১৯১১ সালে দক্ষিণ মেরু জয়ের সময় খাদ্যতালিকায় চকোলেট রাখেন। এরপর থেকেই নরওয়েজীয়রা প্রাকৃতিক অভিযানে চকোলেট নিতে শুরু করে। হোলস্ট তখন সিদ্ধান্ত নেন, এমন একটি ওয়েফার বার বানাতে হবে যা ভ্রমণের সঙ্গী হবে। তবে প্রথম সংস্করণ ব্যর্থ হয়, কারণ সেটি ছিল ডার্ক চকোলেট। দ্রুত মিল্ক চকোলেটে বদলে দেওয়া হলে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

Alamy Norwegians have been using Kvikk Lunsj to power their outdoor adventures for generations (Credit: Alamy)

স্বাদের বৈশিষ্ট্য ও বাজারজাতকরণ

লাল, সবুজ আর হলুদ মোড়কের ভেতরে থাকে চার ফালি চকোলেট ওয়েফার, যেটি হালকা কিন্তু পুষ্টিকর। ১৯৩০-এর দশকেই বিজ্ঞাপন বলেছিল, একটি বার সমান শক্তি দেয় একটি ডিম আর মাখন মাখানো দুই টুকরো পাউরুটির মতো। নরওয়েজীয়রা এটিকে শুধু চকোলেট নয়, প্রায় এনার্জি বারের সমতুল্য মনে করে।

‘তুর’ বা ভ্রমণ সংস্কৃতির সঙ্গে কুইক লাঞ্চকে এক করে দেখা হয়। পাহাড়ে বসে কমলা খাওয়া, সসেজ পোড়ানো আর সঙ্গে কুইক লাঞ্চ – এগুলো নরওয়ের খোলা আকাশের জীবনের প্রতীক।


যুদ্ধ-পরবর্তী বিস্তার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে জার্মান দখলমুক্ত হওয়ার পর নরওয়েজীয়রা স্বাধীনতার স্বাদ পেল। তখন থেকেই কুইক লাঞ্চ হয়ে ওঠে জাতীয় প্রতীকের অংশ। ১৯৬০-এর দশকে যখন গ্রামে কটেজ বানানোর চল শুরু হয়, তখন প্রায় সবাই ভ্রমণে সঙ্গে নিত এই বার। আজ নরওয়ের অর্ধেক পরিবারেরই পাহাড়ি কটেজ আছে, আর কুইক লাঞ্চ সেখানে অপরিহার্য খাবার হিসেবে টিকে আছে।

Ola Heggem Kvikk Lunsj is kind of like a Norwegian energy bar (Credit: Ola Heggem)

বিতর্ক: কিটক্যাটের অনুকরণ?

যদিও কুইক লাঞ্চকে নরওয়ের নিজস্ব ব্র্যান্ড বলা হয়, শুরু থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। এর চার ফালি গঠন ব্রিটিশ কিটক্যাটের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। কিটক্যাট ১৯৩৫ সালে বাজারে আসে, আর কুইক লাঞ্চ তার দুই বছর পর। ধারণা করা হয়, হোলস্ট ইংল্যান্ডে গিয়ে কিটক্যাট দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কোম্পানি অবশ্য কখনও তা স্বীকার করেনি।

আরেক বিতর্ক আসে মালিকানা নিয়ে। ১৯৯৩ সালে ফ্রেইয়া বিক্রি হয়ে যায় আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ক্রাফট (বর্তমান মন্ডেলেজ়)-এর কাছে। এতে নরওয়েজীয়রা আশঙ্কা করেছিল, হয়তো ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। এমনকি ২০২৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের বয়কটের মুখে পড়ে মন্ডেলেজ়।


কিটক্যাট বনাম কুইক লাঞ্চ

বছরের পর বছর কিটক্যাট ও কুইক লাঞ্চ একে অপরকে সম্মানজনক দূরত্বে রেখেছে। তবে সম্প্রতি কিটক্যাট নরওয়ের বাজারে প্রবেশের ঘোষণা দিলে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। ইউরোপীয় আদালতের রায়ে কিটক্যাট চার ফালি ডিজাইন একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে নরওয়ের ভেতরে শুধু কুইক লাঞ্চই চার ফালি বার বিক্রি করতে পারবে। কিটক্যাট সেখানে বিক্রি করবে ভিন্ন নকশার ‘চাঙ্কি’ বার।

Getty Images Kvikk Lunsj is as Norwegian as cabins, fjords and mountains (Credit: Getty Images)

স্বাদের দিক থেকে কোনটি সেরা? ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানের স্বাদ পরীক্ষায় কুইক লাঞ্চ এগিয়ে ছিল।


জাতীয় স্মৃতি ও পরিচয়

কুইক লাঞ্চ শুধু চকোলেট নয়, বরং শৈশবের স্মৃতি, পারিবারিক ভ্রমণ আর জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। নরওয়েজীয়দের কাছে এটি কেবিন, পাহাড় আর ফিওর্ডের মতোই নিজস্ব। অনেকের মতে, এটি এমন এক স্বাদ যা শুধু মিষ্টি নয় – বরং তাদেরকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নরওয়ের ভ্রমণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘কুইক লাঞ্চ’

১১:৫৫:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

ভ্রমণের সঙ্গী ‘কুইক লাঞ্চ’

নরওয়ের মানুষের কাছে আউটডোর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বিশেষ চকোলেট বার – কুইক লাঞ্চ। স্থানীয়রা একে বলে ‘ট্রিপ চকোলেট’। পাহাড়ে ওঠা, স্কি করা কিংবা বনে ঘোরার সময় প্রায় সবাই সঙ্গে রাখে এই চার ফালি ওয়েফার। প্রতিবছর প্রায় ৬ কোটি বার তৈরি হয়, অর্থাৎ প্রতি নরওয়েজীয়ের জন্য গড়ে ১১টি। এটি কেবল একটি মিষ্টি নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।

Ola Heggem Kvikk Lunsj has long been called a KitKat knockoff (Credit: Ola Heggem)

জন্ম কাহিনি: ব্যর্থ এক ভ্রমণ থেকে

১৯৩৭ সালে কুইক লাঞ্চ বাজারে আসে। কিন্তু এর গল্প শুরু হয়েছিল ১৮৯০-এর দশকে, যখন ব্যবসায়ী জোহান থ্রোনে হোলস্ট জার্মান এক সহকর্মীকে নিয়ে অসলোর বাইরে বনে পথ হারান। ক্ষুধার্ত অবস্থায় জার্মান সহকর্মী বলেছিলেন, যদি চকোলেট থাকত, যাত্রা অনেক সহজ হতো। দুই বছর পর হোলস্ট ছোট একটি চকোলেট কারখানা ‘ফ্রেইয়া’ কিনে নেন এবং কয়েক দশকের মধ্যে সেটিকে জাতীয় ব্র্যান্ডে পরিণত করেন।

নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেন ১৯১১ সালে দক্ষিণ মেরু জয়ের সময় খাদ্যতালিকায় চকোলেট রাখেন। এরপর থেকেই নরওয়েজীয়রা প্রাকৃতিক অভিযানে চকোলেট নিতে শুরু করে। হোলস্ট তখন সিদ্ধান্ত নেন, এমন একটি ওয়েফার বার বানাতে হবে যা ভ্রমণের সঙ্গী হবে। তবে প্রথম সংস্করণ ব্যর্থ হয়, কারণ সেটি ছিল ডার্ক চকোলেট। দ্রুত মিল্ক চকোলেটে বদলে দেওয়া হলে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

Alamy Norwegians have been using Kvikk Lunsj to power their outdoor adventures for generations (Credit: Alamy)

স্বাদের বৈশিষ্ট্য ও বাজারজাতকরণ

লাল, সবুজ আর হলুদ মোড়কের ভেতরে থাকে চার ফালি চকোলেট ওয়েফার, যেটি হালকা কিন্তু পুষ্টিকর। ১৯৩০-এর দশকেই বিজ্ঞাপন বলেছিল, একটি বার সমান শক্তি দেয় একটি ডিম আর মাখন মাখানো দুই টুকরো পাউরুটির মতো। নরওয়েজীয়রা এটিকে শুধু চকোলেট নয়, প্রায় এনার্জি বারের সমতুল্য মনে করে।

‘তুর’ বা ভ্রমণ সংস্কৃতির সঙ্গে কুইক লাঞ্চকে এক করে দেখা হয়। পাহাড়ে বসে কমলা খাওয়া, সসেজ পোড়ানো আর সঙ্গে কুইক লাঞ্চ – এগুলো নরওয়ের খোলা আকাশের জীবনের প্রতীক।


যুদ্ধ-পরবর্তী বিস্তার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে জার্মান দখলমুক্ত হওয়ার পর নরওয়েজীয়রা স্বাধীনতার স্বাদ পেল। তখন থেকেই কুইক লাঞ্চ হয়ে ওঠে জাতীয় প্রতীকের অংশ। ১৯৬০-এর দশকে যখন গ্রামে কটেজ বানানোর চল শুরু হয়, তখন প্রায় সবাই ভ্রমণে সঙ্গে নিত এই বার। আজ নরওয়ের অর্ধেক পরিবারেরই পাহাড়ি কটেজ আছে, আর কুইক লাঞ্চ সেখানে অপরিহার্য খাবার হিসেবে টিকে আছে।

Ola Heggem Kvikk Lunsj is kind of like a Norwegian energy bar (Credit: Ola Heggem)

বিতর্ক: কিটক্যাটের অনুকরণ?

যদিও কুইক লাঞ্চকে নরওয়ের নিজস্ব ব্র্যান্ড বলা হয়, শুরু থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। এর চার ফালি গঠন ব্রিটিশ কিটক্যাটের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। কিটক্যাট ১৯৩৫ সালে বাজারে আসে, আর কুইক লাঞ্চ তার দুই বছর পর। ধারণা করা হয়, হোলস্ট ইংল্যান্ডে গিয়ে কিটক্যাট দেখে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কোম্পানি অবশ্য কখনও তা স্বীকার করেনি।

আরেক বিতর্ক আসে মালিকানা নিয়ে। ১৯৯৩ সালে ফ্রেইয়া বিক্রি হয়ে যায় আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ক্রাফট (বর্তমান মন্ডেলেজ়)-এর কাছে। এতে নরওয়েজীয়রা আশঙ্কা করেছিল, হয়তো ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। এমনকি ২০২৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের বয়কটের মুখে পড়ে মন্ডেলেজ়।


কিটক্যাট বনাম কুইক লাঞ্চ

বছরের পর বছর কিটক্যাট ও কুইক লাঞ্চ একে অপরকে সম্মানজনক দূরত্বে রেখেছে। তবে সম্প্রতি কিটক্যাট নরওয়ের বাজারে প্রবেশের ঘোষণা দিলে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। ইউরোপীয় আদালতের রায়ে কিটক্যাট চার ফালি ডিজাইন একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে নরওয়ের ভেতরে শুধু কুইক লাঞ্চই চার ফালি বার বিক্রি করতে পারবে। কিটক্যাট সেখানে বিক্রি করবে ভিন্ন নকশার ‘চাঙ্কি’ বার।

Getty Images Kvikk Lunsj is as Norwegian as cabins, fjords and mountains (Credit: Getty Images)

স্বাদের দিক থেকে কোনটি সেরা? ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানের স্বাদ পরীক্ষায় কুইক লাঞ্চ এগিয়ে ছিল।


জাতীয় স্মৃতি ও পরিচয়

কুইক লাঞ্চ শুধু চকোলেট নয়, বরং শৈশবের স্মৃতি, পারিবারিক ভ্রমণ আর জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। নরওয়েজীয়দের কাছে এটি কেবিন, পাহাড় আর ফিওর্ডের মতোই নিজস্ব। অনেকের মতে, এটি এমন এক স্বাদ যা শুধু মিষ্টি নয় – বরং তাদেরকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে।