সৌন্দর্যচর্চায় নতুন আলো
মানুষ আজকাল ঘরে বসেই নানা ধরনের স্বযত্নের গোপন অভ্যাসে মগ্ন থাকে। সাম্প্রতিক প্রবণতার মধ্যে একটি হলো মুখে বিশেষ আলো নিঃসরণকারী মাস্ক পরা। দেখতে এটি যেন কোনো ভৌতিক সিনেমার চরিত্রের মুখোশ—চোখ ও মুখের ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বলে আলো বেরোয়। কিন্তু এর লক্ষ্য ভয় নয়, বরং তারুণ্য ধরে রাখা।
এই আলো নিঃসরণকারী বা এলইডি (LED) মাস্কগুলো বর্তমানে সৌন্দর্যজগতের নতুন আসক্তি। মাস্কের আলোর রঙ অনুযায়ী প্রস্তুতকারকরা দাবি করেন, এটি ব্রণ দূর করে, ত্বকের দাগ হালকা করে এবং বলিরেখা প্রতিরোধ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো লাল আলো নিঃসরণকারী মাস্ক, যা লাল ও নিকট ইনফ্রারেড (NIR) আলো ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আলোকরশ্মি ত্বকের পুনর্গঠন ঘটিয়ে বার্ধক্যের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
কীভাবে কাজ করে লাল আলো
লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ফলে এটি ত্বকের গভীরে প্রবেশ করতে পারে, ক্ষতি ছাড়াই। এই আলো ত্বকের নিচের স্তরের রঙসংবেদনশীল অণু বা ক্রোমোফোরকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে ত্বকের ফাইব্রোব্লাস্ট নামের কোষ সক্রিয় হয়, যারা ক্ষত বা কোষক্ষতির প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল। এই কোষই কোলাজেন ও ইলাস্টিন নামের দুটি প্রোটিন তৈরি করে, যা ত্বকের দৃঢ়তা ও স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে। পর্যাপ্ত কোলাজেন মানে হলো তরুণ ও টানটান ত্বক।
গবেষণার প্রমাণ
২০০৭ সালে জার্নাল অব ফোটোকেমিস্ট্রি অ্যান্ড ফোটোবায়োলজি–তে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৭৬ জন অংশগ্রহণকারী তাঁদের মুখের ডান পাশে লাল আলো ব্যবহার করেন, বাম পাশ রেখে দেন স্বাভাবিক অবস্থায়। মাত্র চার সপ্তাহ পরেই দেখা যায়, ডান পাশের ত্বক আরও তরুণ ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কিছু অংশগ্রহণকারীর ত্বক পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কোলাজেনের পরিমাণ বেড়েছে।
নিউ ইয়র্ক মেডিকেল কলেজের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ড. শোশানা মারমন জানান, ছোট পরিসরের অনেক গবেষণায় লাল আলোর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে—বিশেষ করে ব্রণ, ত্বকের গঠন ও বলিরেখা কমাতে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এর ফলাফল সীমিত এবং ধৈর্য ধরে ব্যবহার করতে হয়। তাঁর পরামর্শ, সপ্তাহে অন্তত তিনবার ৮–১২ সপ্তাহ ধরে লাল আলো মাস্ক ব্যবহার করা উচিত, তবে ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন ও ভিটামিন-এ ভিত্তিক রেটিনয়েডের সঙ্গে মিলিয়ে। তাঁর ভাষায়, “এই আলো মৌলিক যত্নের পরিপূরক হতে পারে, বিকল্প নয়।”
চিকিৎসায় লাল আলোর বিস্ময়কর ব্যবহার
লাল আলোর ব্যবহার শুধু সৌন্দর্যচর্চায় সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৯০–এর দশকে নাসার বিজ্ঞানীরা প্রথমে গাছপালা, পরে ইঁদুর ও মানবকোষে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেন, এলইডি আলো ক্ষত দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে। কারণ মহাকাশের ক্ষুদ্র মাধ্যাকর্ষণ পরিবেশে কোষের বৃদ্ধি ধীর হয়—ফলে আলো চিকিৎসা সেখানে বিশেষভাবে উপকারী।
এছাড়া সোরিয়াসিস, ভিটিলিগো, ব্রণের দাগ, রোসেশিয়া এবং এমনকি ত্বকের ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসায়ও আলোর ব্যবহার কার্যকর বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, আলো ত্বকের নিচের কোষ পুনর্গঠন করতে সক্ষম হওয়ায় এটি মস্তিষ্কে আঘাতজনিত ক্ষতির চিকিৎসাতেও কাজে লাগতে পারে।
সব মাস্ক সমান নয়
তবে বাজারে সব ধরনের মুখোশেই যে লাল আলোর সম্পূর্ণ উপকার মেলে, তা নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, ত্বক তরুণ ও বলিরেখাহীন রাখতে সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা হলো লাল আলো (কমপক্ষে ৬৩৩ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য) এবং নিকট ইনফ্রারেড আলো (কমপক্ষে ৮৩০ ন্যানোমিটার)-এর সম্মিলিত ব্যবহার।
এছাড়া মাস্কে ব্যবহৃত বাতিগুলোর আলোর ঘনত্বও যথেষ্ট হতে হবে—প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে অন্তত ১০ থেকে ৫০ মিলিওয়াট। তবেই এই “যৌবনের আভা” সত্যিকার অর্থে বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকর হতে পারে।