০৭:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫

উন্নয়নের চাপে সবুজবিনাশ

সবুজ হারাচ্ছে শহর

দেশের বিভিন্ন শহরে দ্রুত নগরায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে সবুজ গাছপালার পরিমাণ দ্রুত কমছে। সাম্প্রতিক এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল গত পাঁচ বছরেই শহরাঞ্চলে গাছপালার পরিমাণ প্রায় ২৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে জলাশয়ের পরিমাণও কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের শীতকালের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২.৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস; কিছু এলাকায় তা ৪ ডিগ্রিতেও পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবুজ এলাকা ও জলাশয় ধ্বংসই এই উষ্ণায়নের প্রধান কারণ।


উন্নয়ন প্রকল্পে গাছ কাটার হিড়িক

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হাজার হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। শুধু তিনটি বড় প্রকল্পেই কাটা হচ্ছে প্রায় ২,৬৩১টি গাছ। এর মধ্যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে সবচেয়ে বেশি—১,৮৫৩টি গাছ কাটা হবে। পানি শোধনাগার প্রকল্পে আরও ৭২৬টি এবং সার্কিট হাউস সম্প্রসারণে ৫২টি গাছ কাটার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্প–সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নয়নের প্রয়োজনে গাছ কাটা অনিবার্য, না হলে কাজ থেমে যাবে। তবে পরিবেশবাদীরা একে “সবুজের ওপর আঘাত” বলে সমালোচনা করছেন। তাঁদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে শহরাঞ্চল আরও উষ্ণ ও বাসযোগ্যতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।


পানি শোধনাগার প্রকল্পে গাছ নিধনের অভিযোগ

একটি বৃহৎ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়কের এক পাশে গাছ কাটা হয়েছে। নদী থেকে শহরে পানি সরবরাহের জন্য ৪,০৬২ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ইতিমধ্যে শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে, আরও শতাধিক গাছ নিলামে তোলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণের বাজেট না থাকায় সরকারি জমিতেই কাজ করতে হয়েছে, যার ফলে গাছ কাটা এড়ানো যায়নি।


সরকারি স্থাপনা নির্মাণেও গাছ কাটার অনুমোদন

একাধিক সরকারি ভবন, ব্যারাক ও প্রশাসনিক স্থাপনা নির্মাণের জন্যও পুরনো গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিছু গাছ ইতিমধ্যেই নিলামে বিক্রি হয়েছে, তবে সব কাজ এখনো শুরু হয়নি।

পরিবেশবাদীরা এসব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।


মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে সবচেয়ে বড় ক্ষতি

একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে কাটা হবে ১,৮৫৩টি গাছ—যার মধ্যে প্রায় ১,০০০টি আম ও ৬৮৯টি মেহগনি। এর আগেও একই এলাকায় টেন্ডার ছাড়াই এক হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ উঠেছিল, যার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, “প্রতিটি কাটা গাছের বিপরীতে একাধিক গাছ লাগানোর পরিকল্পনা আছে এবং প্রায় অর্ধেক এলাকা সবুজ হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে।”


পরিবেশকর্মীদের সতর্কবার্তা

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, “উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে। এই ধারা চলতে থাকলে দেশের শহরাঞ্চল তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে পড়বে।”

তাঁরা আরও জানান, প্রয়োজনে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে এবং আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না।


বাংলাদেশের বন আচ্ছাদন ও আন্তর্জাতিক মান

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের মোট ভূখণ্ডের অন্তত ২৫ শতাংশ বন বা গাছপালা আচ্ছাদিত থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের বন আচ্ছাদন এখনো ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গাছ কমার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো—
১. অযাচিত নগরায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন
২. শিল্পায়নের চাপ ও কৃষিজমি দখল
৩. অবৈধ দখল ও বন উজাড়
৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

এই প্রবণতা বন্ধ না হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলসংকট ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি অনিবার্য হবে।


সবুজ বাঁচানোর আহ্বান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। যত দ্রুত গাছ কাটা হচ্ছে, তত দ্রুত নতুন গাছ না লাগালে দেশের শহরাঞ্চল “হিট আইল্যান্ড” বা অতিউষ্ণ অঞ্চলে পরিণত হবে।

তাঁদের আহ্বান, “উন্নয়ন হোক, তবে প্রকৃতির ক্ষতি না করে।”


জনপ্রিয় সংবাদ

উন্নয়নের চাপে সবুজবিনাশ

০৪:১৪:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

সবুজ হারাচ্ছে শহর

দেশের বিভিন্ন শহরে দ্রুত নগরায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে সবুজ গাছপালার পরিমাণ দ্রুত কমছে। সাম্প্রতিক এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল গত পাঁচ বছরেই শহরাঞ্চলে গাছপালার পরিমাণ প্রায় ২৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে জলাশয়ের পরিমাণও কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের শীতকালের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২.৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস; কিছু এলাকায় তা ৪ ডিগ্রিতেও পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবুজ এলাকা ও জলাশয় ধ্বংসই এই উষ্ণায়নের প্রধান কারণ।


উন্নয়ন প্রকল্পে গাছ কাটার হিড়িক

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হাজার হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। শুধু তিনটি বড় প্রকল্পেই কাটা হচ্ছে প্রায় ২,৬৩১টি গাছ। এর মধ্যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে সবচেয়ে বেশি—১,৮৫৩টি গাছ কাটা হবে। পানি শোধনাগার প্রকল্পে আরও ৭২৬টি এবং সার্কিট হাউস সম্প্রসারণে ৫২টি গাছ কাটার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্প–সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নয়নের প্রয়োজনে গাছ কাটা অনিবার্য, না হলে কাজ থেমে যাবে। তবে পরিবেশবাদীরা একে “সবুজের ওপর আঘাত” বলে সমালোচনা করছেন। তাঁদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে শহরাঞ্চল আরও উষ্ণ ও বাসযোগ্যতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।


পানি শোধনাগার প্রকল্পে গাছ নিধনের অভিযোগ

একটি বৃহৎ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়কের এক পাশে গাছ কাটা হয়েছে। নদী থেকে শহরে পানি সরবরাহের জন্য ৪,০৬২ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ইতিমধ্যে শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে, আরও শতাধিক গাছ নিলামে তোলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণের বাজেট না থাকায় সরকারি জমিতেই কাজ করতে হয়েছে, যার ফলে গাছ কাটা এড়ানো যায়নি।


সরকারি স্থাপনা নির্মাণেও গাছ কাটার অনুমোদন

একাধিক সরকারি ভবন, ব্যারাক ও প্রশাসনিক স্থাপনা নির্মাণের জন্যও পুরনো গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিছু গাছ ইতিমধ্যেই নিলামে বিক্রি হয়েছে, তবে সব কাজ এখনো শুরু হয়নি।

পরিবেশবাদীরা এসব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।


মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে সবচেয়ে বড় ক্ষতি

একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে কাটা হবে ১,৮৫৩টি গাছ—যার মধ্যে প্রায় ১,০০০টি আম ও ৬৮৯টি মেহগনি। এর আগেও একই এলাকায় টেন্ডার ছাড়াই এক হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ উঠেছিল, যার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, “প্রতিটি কাটা গাছের বিপরীতে একাধিক গাছ লাগানোর পরিকল্পনা আছে এবং প্রায় অর্ধেক এলাকা সবুজ হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে।”


পরিবেশকর্মীদের সতর্কবার্তা

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, “উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে। এই ধারা চলতে থাকলে দেশের শহরাঞ্চল তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে পড়বে।”

তাঁরা আরও জানান, প্রয়োজনে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে এবং আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না।


বাংলাদেশের বন আচ্ছাদন ও আন্তর্জাতিক মান

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের মোট ভূখণ্ডের অন্তত ২৫ শতাংশ বন বা গাছপালা আচ্ছাদিত থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের বন আচ্ছাদন এখনো ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গাছ কমার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো—
১. অযাচিত নগরায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন
২. শিল্পায়নের চাপ ও কৃষিজমি দখল
৩. অবৈধ দখল ও বন উজাড়
৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

এই প্রবণতা বন্ধ না হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলসংকট ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি অনিবার্য হবে।


সবুজ বাঁচানোর আহ্বান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। যত দ্রুত গাছ কাটা হচ্ছে, তত দ্রুত নতুন গাছ না লাগালে দেশের শহরাঞ্চল “হিট আইল্যান্ড” বা অতিউষ্ণ অঞ্চলে পরিণত হবে।

তাঁদের আহ্বান, “উন্নয়ন হোক, তবে প্রকৃতির ক্ষতি না করে।”