০১:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

ত্বকের কোষ থেকে মানব ডিম্বাণু তৈরির দৌড়ে নতুন অগ্রগতি

প্রজননবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত

বিশ্বজুড়ে বহু দম্পতি সন্তান ধারণে ব্যর্থ হন। অনেকেই ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ), মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু নারীর যদি ব্যবহারযোগ্য ডিম্বাণু না থাকে, তখন বিকল্প হিসেবে থাকে দাতা ডিম্বাণু ব্যবহার করা বা সম্পূর্ণভাবে আশা ছেড়ে দেওয়া। এই সমস্যার সমাধানেই বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন কৃত্রিমভাবে নারীর ডিম্বাণু তৈরি করতে। এতদিন পর্যন্ত কেবল ইঁদুরের ক্ষেত্রে এটি সফল হয়েছিল, কিন্তু এবার মানবদেহে সম্ভাবনার দ্বার খুলছে।

সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রথমবারের মতো ত্বকের কোষ থেকে মানব ডিম্বাণু তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন—যদিও তা এখনো নিখুঁত নয়।


পূর্বের পদ্ধতি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

আগে বিজ্ঞানীরা ইন ভিট্রো গ্যামেটোজেনেসিস: IVG নামে একটি পদ্ধতিতে কাজ করতেন, যেখানে ত্বকের কোষকে স্টেম সেলে রূপান্তর করে পরে তা থেকে ডিম্বাণু তৈরির চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত জটিল।

ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির শৌখরাত মিতালিপভের নেতৃত্বাধীন দল এবার নতুনভাবে পুরনো একটি পদ্ধতি পুনরায় প্রয়োগ করেছেন—সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার (SCNT)। এই পদ্ধতিই একসময় বিখ্যাত ভেড়া “ডলি” তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। এইবার তাঁরা এতে এক অভিনব ধাপ যুক্ত করেছেন।

Skin DNA breakthrough could let 60-year-old women have genetically related kids

পরীক্ষার প্রক্রিয়া

গবেষক দলটি প্রথমে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তাদের নিউক্লিয়াস অপসারণ করেন। তারপর অন্য স্বেচ্ছাসেবীদের ত্বকের কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোর মধ্যে থেকে পৃথক কোষ ডিম্বাণুর সঙ্গে যুক্ত করেন।

যদি তারা ক্লোনিং করতেন—যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ—তাহলে এই কোষগুলো থেকে ভ্রূণ তৈরি হতো। কিন্তু গবেষকদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন: বন্ধ্যা দম্পতির জন্য এমন একটি ডিম্বাণু তৈরি করা যা স্বাভাবিকভাবে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে।


ক্রোমোজোমের জটিলতা

মানবদেহের সাধারণ কোষে থাকে ৪৬টি ক্রোমোজোম, অথচ ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে থাকে ২৩টি করে। ফলে নিষেকের পর সংখ্যা আবার ৪৬ হয়। কিন্তু ত্বকের কোষ থেকে নেওয়া নিউক্লিয়াসে ৪৬টি ক্রোমোজোমই থেকে যায়, ফলে তা নিষেকের জন্য উপযুক্ত থাকে না।

এই সমস্যা কাটাতে মিতালিপভের দল এক অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘মাইটোমিওসিস’। স্বাভাবিকভাবে মাইটোসিসে কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোম দ্বিগুণ হয়, আর মিওসিসে অর্ধেক থাকে—যেমন ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে। কিন্তু গবেষক দলটি এমনভাবে কোষ বিভাজন প্ররোচিত করেছে যাতে ক্রোমোজোম অর্ধেকে নেমে আসে, ফলে ডিম্বাণুটি নিষেকযোগ্য হয়।


পরীক্ষার ফলাফল ও সীমাবদ্ধতা

এই পদ্ধতিতে ৮২টি SCNT ডিম্বাণু তৈরি করা হয়, এবং পরে তা শুক্রাণুর মাধ্যমে নিষিক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৫টি ডিম্বাণু ভ্রূণের প্রাথমিক স্তর ব্লাস্টোসিস্ট-এ উন্নীত হয়, এরপর পরীক্ষা বন্ধ করা হয়।

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজননবিজ্ঞানী ইভলিন টেলফার একে “অসাধারণ সাফল্য” বলে অভিহিত করেছেন, যদিও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে এটি বাস্তব প্রজননে ব্যবহারের আগে অনেক দূর যেতে হবে। অধিকাংশ ডিম্বাণু বিকশিত হয়নি, ফলে প্রক্রিয়াটি জটিল ও ব্যয়বহুল হয়েছে।

আরেক গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব বাথের টনি পেরি বলেছেন, এই পদ্ধতিতে কোন ক্রোমোজোম বাদ যাচ্ছে বা কতগুলো বাদ যাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই ক্রোমোজোম জোড়া সঠিকভাবে মেলেনি।

Revolutionary Breakthrough: Creating Human Eggs from Skin Cells | Science-Environment

নৈতিক প্রশ্ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মিতালিপভ জানিয়েছেন, তাঁর দল এখন মিওসিস প্রক্রিয়াটি আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, যাতে মাইটোমিওসিসে তা সঠিকভাবে পুনর্গঠন করা যায়। তবে বাস্তবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্তানহীন দম্পতির চিকিৎসা শুরু হতে এখনও বহু বছর বাকি।

এছাড়া নৈতিক প্রশ্ন বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে—কে এই চিকিৎসা নিতে পারবেন, অতিরিক্ত ভ্রূণগুলোর কী হবে, ইত্যাদি বিষয়ে জনমত ও নীতিগত বিতর্ক চলবে দীর্ঘদিন।


প্রতিযোগিতার দৌড়ে গবেষকরা

ত্বকের কোষ থেকে ডিম্বাণু তৈরির গবেষণায় এখন একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অন্তত একটি গোপন সংস্থা, কনসেপশন বায়ো, এই প্রযুক্তির স্টেম সেল সংস্করণ নিয়ে কাজ করছে।

জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট কাটসুহিকো হায়াশি, যিনি স্টেম সেল পদ্ধতির পথিকৃৎ, সম্প্রতি বলেছেন—“এখন মনে হচ্ছে আমরা যেন এক দৌড়ে আছি।”

 

জনপ্রিয় সংবাদ

ত্বকের কোষ থেকে মানব ডিম্বাণু তৈরির দৌড়ে নতুন অগ্রগতি

১০:০০:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫

প্রজননবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত

বিশ্বজুড়ে বহু দম্পতি সন্তান ধারণে ব্যর্থ হন। অনেকেই ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ), মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু নারীর যদি ব্যবহারযোগ্য ডিম্বাণু না থাকে, তখন বিকল্প হিসেবে থাকে দাতা ডিম্বাণু ব্যবহার করা বা সম্পূর্ণভাবে আশা ছেড়ে দেওয়া। এই সমস্যার সমাধানেই বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন কৃত্রিমভাবে নারীর ডিম্বাণু তৈরি করতে। এতদিন পর্যন্ত কেবল ইঁদুরের ক্ষেত্রে এটি সফল হয়েছিল, কিন্তু এবার মানবদেহে সম্ভাবনার দ্বার খুলছে।

সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রথমবারের মতো ত্বকের কোষ থেকে মানব ডিম্বাণু তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন—যদিও তা এখনো নিখুঁত নয়।


পূর্বের পদ্ধতি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

আগে বিজ্ঞানীরা ইন ভিট্রো গ্যামেটোজেনেসিস: IVG নামে একটি পদ্ধতিতে কাজ করতেন, যেখানে ত্বকের কোষকে স্টেম সেলে রূপান্তর করে পরে তা থেকে ডিম্বাণু তৈরির চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত জটিল।

ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির শৌখরাত মিতালিপভের নেতৃত্বাধীন দল এবার নতুনভাবে পুরনো একটি পদ্ধতি পুনরায় প্রয়োগ করেছেন—সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার (SCNT)। এই পদ্ধতিই একসময় বিখ্যাত ভেড়া “ডলি” তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। এইবার তাঁরা এতে এক অভিনব ধাপ যুক্ত করেছেন।

Skin DNA breakthrough could let 60-year-old women have genetically related kids

পরীক্ষার প্রক্রিয়া

গবেষক দলটি প্রথমে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তাদের নিউক্লিয়াস অপসারণ করেন। তারপর অন্য স্বেচ্ছাসেবীদের ত্বকের কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোর মধ্যে থেকে পৃথক কোষ ডিম্বাণুর সঙ্গে যুক্ত করেন।

যদি তারা ক্লোনিং করতেন—যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ—তাহলে এই কোষগুলো থেকে ভ্রূণ তৈরি হতো। কিন্তু গবেষকদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন: বন্ধ্যা দম্পতির জন্য এমন একটি ডিম্বাণু তৈরি করা যা স্বাভাবিকভাবে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে।


ক্রোমোজোমের জটিলতা

মানবদেহের সাধারণ কোষে থাকে ৪৬টি ক্রোমোজোম, অথচ ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে থাকে ২৩টি করে। ফলে নিষেকের পর সংখ্যা আবার ৪৬ হয়। কিন্তু ত্বকের কোষ থেকে নেওয়া নিউক্লিয়াসে ৪৬টি ক্রোমোজোমই থেকে যায়, ফলে তা নিষেকের জন্য উপযুক্ত থাকে না।

এই সমস্যা কাটাতে মিতালিপভের দল এক অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘মাইটোমিওসিস’। স্বাভাবিকভাবে মাইটোসিসে কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোম দ্বিগুণ হয়, আর মিওসিসে অর্ধেক থাকে—যেমন ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে। কিন্তু গবেষক দলটি এমনভাবে কোষ বিভাজন প্ররোচিত করেছে যাতে ক্রোমোজোম অর্ধেকে নেমে আসে, ফলে ডিম্বাণুটি নিষেকযোগ্য হয়।


পরীক্ষার ফলাফল ও সীমাবদ্ধতা

এই পদ্ধতিতে ৮২টি SCNT ডিম্বাণু তৈরি করা হয়, এবং পরে তা শুক্রাণুর মাধ্যমে নিষিক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৫টি ডিম্বাণু ভ্রূণের প্রাথমিক স্তর ব্লাস্টোসিস্ট-এ উন্নীত হয়, এরপর পরীক্ষা বন্ধ করা হয়।

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজননবিজ্ঞানী ইভলিন টেলফার একে “অসাধারণ সাফল্য” বলে অভিহিত করেছেন, যদিও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে এটি বাস্তব প্রজননে ব্যবহারের আগে অনেক দূর যেতে হবে। অধিকাংশ ডিম্বাণু বিকশিত হয়নি, ফলে প্রক্রিয়াটি জটিল ও ব্যয়বহুল হয়েছে।

আরেক গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব বাথের টনি পেরি বলেছেন, এই পদ্ধতিতে কোন ক্রোমোজোম বাদ যাচ্ছে বা কতগুলো বাদ যাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই ক্রোমোজোম জোড়া সঠিকভাবে মেলেনি।

Revolutionary Breakthrough: Creating Human Eggs from Skin Cells | Science-Environment

নৈতিক প্রশ্ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মিতালিপভ জানিয়েছেন, তাঁর দল এখন মিওসিস প্রক্রিয়াটি আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, যাতে মাইটোমিওসিসে তা সঠিকভাবে পুনর্গঠন করা যায়। তবে বাস্তবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্তানহীন দম্পতির চিকিৎসা শুরু হতে এখনও বহু বছর বাকি।

এছাড়া নৈতিক প্রশ্ন বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে—কে এই চিকিৎসা নিতে পারবেন, অতিরিক্ত ভ্রূণগুলোর কী হবে, ইত্যাদি বিষয়ে জনমত ও নীতিগত বিতর্ক চলবে দীর্ঘদিন।


প্রতিযোগিতার দৌড়ে গবেষকরা

ত্বকের কোষ থেকে ডিম্বাণু তৈরির গবেষণায় এখন একধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অন্তত একটি গোপন সংস্থা, কনসেপশন বায়ো, এই প্রযুক্তির স্টেম সেল সংস্করণ নিয়ে কাজ করছে।

জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট কাটসুহিকো হায়াশি, যিনি স্টেম সেল পদ্ধতির পথিকৃৎ, সম্প্রতি বলেছেন—“এখন মনে হচ্ছে আমরা যেন এক দৌড়ে আছি।”