ডিজিটাল যুগের নতুন বাস্তবতা
মায়া রহমান, বয়স ৩২। পেশায় একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। ২০২4 সালের শুরুতে তিনি একটি নতুন আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে যোগ দেন। অফিস নয়, নিজের ঘরের কোণে ছোট্ট এক টেবিলেই এখন তার কর্মজীবন সীমাবদ্ধ।
এক বছর কেটে গেছে, তবু তিনি সহকর্মীদের কাউকে সামনাসামনি দেখেননি। প্রতিদিনের কাজ ইমেইল, স্ল্যাক মেসেজ, ভিডিও কল আর ডেডলাইন ঘিরে।
“প্রথমে এটা খুবই রোমাঞ্চকর ছিল,” বলেন মায়া। “ভোরবেলা উঠে অফিস ধরতে হবে না, ট্রাফিক নেই, নিজের মতো সময় বাঁচিয়ে কাজ করতে পারব— সবই যেন এক নতুন স্বাধীনতার স্বাদ। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, এই স্বাধীনতার ভেতরেই একটা একাকিত্ব লুকিয়ে আছে।”
নিঃসঙ্গতার ঘেরাটোপ
দূরবর্তী কাজ বা রিমোট ওয়ার্ক এখন এক বিশ্বজনীন প্রবণতা। কিন্তু প্রতিটি ডিজিটাল স্ক্রিনের আড়ালে একজন মানুষ রয়েছেন, যিনি হয়তো নিঃসঙ্গতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন।
মায়া প্রতিদিন সকালেই কম্পিউটার চালু করেন, লগইন করেন কোম্পানির পোর্টালে। একে একে কাজ জমে, রিপোর্ট পাঠাতে হয়, নতুন প্রজেক্টের খসড়া তৈরি করতে হয়। কিন্তু পাশে কেউ নেই।
“কাজের ফাঁকে একটু গল্প করার মানুষও নেই,” বলেন তিনি। “মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি শুধু একটা মেশিনের অংশ হয়ে গেছি— নাম, পদবি আর টাস্ক লিস্ট।”
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই একাকিত্বের কারণ শুধু সামাজিক নয়, মানসিকও। দীর্ঘ সময় নিরব পরিবেশে কাজ করার ফলে মানুষের ‘ডোপামিন’ ও ‘সেরোটোনিন’ নামের সুখ-উৎপাদক হরমোনের মাত্রা কমে যায়। ফলে মনোবল, মনোযোগ ও কাজের আনন্দ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়।
কর্মজীবন না কি ডিজিটাল বন্দিত্ব
রিমোট কাজের সুবিধা যত, অসুবিধাও তত গভীর। অনেকে অফিসের চাপে ক্লান্ত হয়ে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’কে মুক্তি ভেবেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা অনেকের কাছে পরিণত হয়েছে “ডিজিটাল বন্দিত্বে”।
অফিসের মতো নির্দিষ্ট সময় না থাকায় কাজের সময় ও বিশ্রামের সময়ের সীমা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
“রাতে ১১টায়ও যখন মেইল আসে, তখন না খুলে থাকা যায় না,” বলেন মায়া। “কারণ অফিস মানেই এখন ঘর, আর ঘর মানেই অফিস।”
এই সীমাহীন কাজের চক্র ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে তোলে মানুষকে। শরীর বিশ্রাম পেলেও মন পায় না। অনেকে এই অবস্থাকে এখন ‘ওয়ার্ক-লাইফ ডিসঅর্ডার’ বলছেন — যেখানে কাজের ভারসাম্য হারিয়ে যায় জীবনের স্বাভাবিকতার সঙ্গে।
সহকর্মীহীন জীবনের প্রভাব
মানুষ সামাজিক প্রাণী। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, বন্ধুত্ব, প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক সমর্থন শুধু কাজের অংশ নয়, মানসিক ভারসাম্যেরও উৎস।
যখন সেই সম্পর্ক অনুপস্থিত হয়, তখন মানুষ নিজের ভেতরে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে।
মনোচিকিৎসক ডা. নাসরিন আহমেদ বলেন, “দূরবর্তী কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ‘ইমোশনাল ডিটাচমেন্ট’। মানুষ ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকে যে, তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোনো গুরুত্ব বহন করে না।”
মায়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিনি জানান, “কখনও কখনও মনে হয় আমি কোম্পানির এক কোড নম্বর। কেউ জানে না আমি খুশি না দুঃখী। কেবল ফলাফলটাই গুরুত্বপূর্ণ।”
মানসিক স্বাস্থ্য: অবহেলিত বাস্তবতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে রিমোট কর্মীদের মধ্যে ডিপ্রেশন ও উদ্বেগের হার বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে— সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অবিরাম স্ক্রিন টাইম, ও কাজের চাপের সীমাহীনতা।
ডা. নাসরিন বলেন, “যারা একা কাজ করেন, তাদের মস্তিষ্কে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা ক্রমে বেড়ে যায়। ফলে ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের অভাব, এমনকি দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিও তৈরি হয়।”
মায়া এখন নিয়মিত মেডিটেশন করেন, সকালে কিছুক্ষণ হাঁটেন। তিনি বলেন, “আমি শিখেছি, নিজেকে যত্ন না নিলে কাজও ভালো হয় না। মনকে শান্ত রাখা এখন কাজেরই অংশ।”
ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় দূরবর্তীভাবে কাজ করলে নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, অনলাইন গ্রুপে আলোচনা করা, কিংবা কোনো সৃজনশীল শখ— এসবই মানসিক ভারসাম্য রক্ষার উপায়।
মায়া এখন সপ্তাহে একদিন ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ পালন করেন— সেই দিন কোনো কাজ বা ইমেইল নয়, শুধুই নিজের সময়। “আমি বই পড়ি, গান শুনি, কখনও রান্না করি। সেই দিনগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি শুধু কর্মী নই, একজন মানুষও,” বলেন তিনি।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলো এখন ‘হাইব্রিড মডেল’-এর দিকে ঝুঁকছে— যেখানে সপ্তাহে কয়েক দিন অফিসে, বাকিটা ঘরে। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটাই সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান হতে পারে।
কাজের নমনীয়তা বজায় রেখেও সামাজিক যোগাযোগ ফিরিয়ে আনা সম্ভব এই পদ্ধতিতে।
তবে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, সহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতি, এবং নিজেকে বিশ্রাম দেওয়ার অভ্যাস— এগুলোই রিমোট কর্মজীবনের সুস্থ পথ তৈরি করতে পারে।
মায়া রহমানের গল্প শুধু একজন কর্মীর গল্প নয়; এটি আধুনিক কর্মজগতের মানসিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
যেখানে স্বাধীনতা ও একাকিত্ব, প্রযুক্তি ও মানবিকতা এক অদ্ভুত সমীকরণে জড়িয়ে গেছে।
তার এক বছরের যাত্রা আমাদের শেখায়—
“কাজ যতই ডিজিটাল হোক, মানুষের মনের যত্ন নেওয়া এখনো সবচেয়ে বাস্তব।”