বাংলাদেশে এ বছর এডিস মশাজনিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। রোববার অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নয় জন মারা গেছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৪২ জন।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের সাথে এ বছরের তুলনা করলে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। মৃত্যুর হার বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এ বছরের জানুয়ারি থেকে পাঁচই অক্টোবর পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৯০৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছেন ২১২ জন।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। ফলে জনমনে এক ধরনের উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।

অক্টোবর নিয়ে শঙ্কা কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মূলত বর্ষাকালের রোগ। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ে অগাস্ট মাসে।
কিন্তু ২০২১ সাল থেকে এই দৃশ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে। এখন সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি।
২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় অক্টোবর মাসে। এবারও এ মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরির্তনের ফলে এ বছর গত কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক পরিমাণে বৃষ্টিপাতের কারণে অক্টোবরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কীটতত্ত্ববিদ মি. বাশার বলেন, ” দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মশক ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে এ বছর একটু চেইন অব কমাণ্ডটা আমরা দুর্বল দেখি। আরেকটা কারণ হচ্ছে ডেঙ্গুর রোগী যখন বাড়ে তখন এটাকে এপিডেমোলজিকেল ট্রায়াঙ্গেলকে ব্রেক বা ভাঙতে হয়।”
কিন্তু বাংলাদেশ এই ট্রায়াঙ্গেল থামাতে পারছে না, একইসাথে সেক্টর ব্যবস্থাপনাও করা যাচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি কেন?
এডিস মশার লার্ভা বা শূককীটের ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’।
এই ইনডেক্স অনুযায়ী, কোনো স্থানে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০ এর উপরে থাকলে এপিডেমোলজিকেল তত্ত্ব অনুযায়ী সেই স্থানে এই মশাবাহিত রোগ ছড়ায়।
বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০ জেলায় গত কয়েক মাসে সংক্রমণের হার বেশি।
এই জেলাগুলো হলো ঢাকা, বরিশাল, বরগুনা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাজীপুর এবং পিরোজপুর।
এই জেলাগুলোতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর ওপরে রয়েছে। কোনো কোনো জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ৭০ বা ৮০ ও পাওয়া যায় বলে জানান কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই এই মশার ঘনত্ব ২০ এর ওপরে বলে জানান তিনি।
এর আগে, গত জুন মাসের তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোশেরশনের ১৩ টি স্থানকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এদিকে, কুমিল্লার সিভিল সার্জন আলী নূর মোহাম্মদ বশীর আহমেদ অবশ্য দাবি করেন, গত এক মাসে এই জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কোনো মৃত্যুর ঘটনা নেই।
এছাড়া ডেঙ্গু সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে চলে এসছে।
” একটা সময়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় তিনটা গ্রামে খুব বেশি ছিল। গ্রামগুলার নাম হচ্ছে শাহপাড়া, সবজীকান্দি, ডোনার চর। ওইটা মোটামুটি কন্ট্রোলে চলে আসছে। এখন সারা বাংলাদেশের মতোই আবার কুমিল্লাতেও কিছু কিছু আছে।”
মি. আহমেদ জানান, ডেঙ্গুর রোগী আছে, চিকিৎসাও চলছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ডেঙ্গুর ওষুধ আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গত মাসে এই জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৩০ জন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
শুধুই কী সরকারের ব্যর্থতা?
বাংলাদেশের গত ২৬ বছর ধরে ডেঙ্গুর অভিজ্ঞতা থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কারণ হিসেবে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। সেই সাথে জনসচেতনতার অভাবকেও তারা দায়ী করছেন।
চারটি উপাদানের সমন্বয়হীনতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানান তারা।
মি. বাশার বলেন, “বাংলাদেশে ইন্টিগ্রেটেড সেক্টর ম্যানেজম্যান্টের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ করা হয় না। এর চারটা উপাদান এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজম্যান্ট, বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল, কেমিক্যাল এবং কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। এই চারটাকে ইন্টিগ্রেট করতে পারি না। ইন্টিগ্রেট করতে পারলে আমরা সফল হতাম।”
এছাড়া আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের অভাব এই ডেঙ্গু সংক্রমণের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার জন্য দায়ী বলেও মনে করেন মি. বাশার।
তার মতে, মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকলেও এ দুটো মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
তবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতাও না বাড়লে ডেঙ্গু পরিস্থিতির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানী ঢাকায় বহুতল ভবনগুলোর উদাহরণ তুলে ধরে মি. বাশার বলছেন, সেগুলোর একাধিক বেজমেন্টে থাকা কার পার্কিং এ গাড়ি ধোয়ার ফলে প্রচুর পানি জমে থাকায় প্রচুর এডিস মশা পাওয়া যায়। সেখানে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কিভাবে যাবে? বা সেরকম জনবল তাদের আছে কিনা।
ফলে ‘কমিউনিটি এনগেজমেন্ট’ না হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশাজনিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংস্থাগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার অভাব যেমন রয়েছে তেমনি কমিউনিটি এনগেজমেন্টের স্বল্পতাও দায়ী।
যদিও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াও বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স কাজ করে যাচ্ছে। সামনের মাসগুলোতে এ উদ্যোগ আরো বাড়বে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করে এটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান এই উপদেষ্টা।
এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দুইশ ছাড়ানোর কথা জানেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আসিফ মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” অনেক সময় আমাদের যেই সিদ্ধান্ত হয় সেটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ক্ষেত্রেই দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আসলে দেখা যায়। আমরা সেটা সলভ করার চেষ্টা করছি।”
সমস্যা সমাধানে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ডেঙ্গুর মতো কাজগুলো তাই মন্ত্রণালয়ের দক্ষ ব্যক্তিদের দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং “অলরেডি উদ্যোগ নিয়েছি” বলে জানান মি. মাহমুদ।
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে বলে জানান তিনি।
মি. মাহমুদ বলেন, ” সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ যারা স্টেক হোল্ডার আছে তাদের নিয়ে আমাদের একটা টাস্কফোর্স আছে। সর্বশেষ মিটিং এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টাস্কফোর্স কাজও করে যাচ্ছে। যেহেতু এই সময়টাতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে আমার ইতোমধ্যেই ইন্টারনালি সংস্থাগুলোর মধ্যে কথা হয়েছে।”
এই কমিটির বৈঠক এই সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
ডেঙ্গুর স্থায়ী সমাধানের জন্য এডিস মশার লার্ভা ও মশক নিধনের জন্য পৃথিবীতে কার্যকরী যেসব ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কাজ করছেন বলেও জানান স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
BBC News বাংলা