বিজ্ঞান কল্পনার জগৎ যেখানে একসময় শুধু স্বপ্নে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে আজ চীন বাস্তবের মাটিতে তা具 আকার দিয়েছে। “দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ” থেকে “শেনঝৌ-১৩”—চীনের চলচ্চিত্র ও প্রযুক্তি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে কল্পনা ও বাস্তবের সীমারেখা প্রায় মুছে গেছে।
এক শতাব্দীর কল্পনা থেকে বাস্তবতার অভিযাত্রা
১৯২৫ সালে সাংহাইয়ে মুক্তি পেয়েছিল চীনের প্রথম সাই-ফাই উপাদানধর্মী চলচ্চিত্র দ্য ইনভিজিবল ক্লোদিং—একজন মানুষ অদৃশ্য চাদর পরে স্ত্রীর প্রেমিকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়, এমন এক হাস্যরসাত্মক গল্প। পরিচালক শু ঝুয়োদাই, যাকে “চায়নার চার্লি চ্যাপলিন” বলা হতো, বিদেশে শিক্ষা শেষে এই সিনেমায় যোগ করেছিলেন বিজ্ঞান কল্পনার ছোঁয়া।
এরপর বহু দশক ধরে চীনা সিনেমায় কল্পনা চলেছে নানা পথে—১৯৮০ সালের ডেথ রে অন কোরাল আইল্যান্ড ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাই-ফাই ছবি। তবে এরপরই ঘনিয়ে আসে দীর্ঘ নীরবতা। নব্বইয়ের দশকে হলিউডের স্টার ওয়ার্সসহ জনপ্রিয় ছবিগুলো নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে বিজ্ঞান কল্পনায় ফিরিয়ে আনে।
২০১৫ সালে লিউ সিসিনের দ্য থ্রি-বডি প্রোবলেম উপন্যাসের জন্য হিউগো অ্যাওয়ার্ড জয় চীনা সাই-ফাইকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যায়। আর ২০১৯ সালে তাঁরই গল্প অবলম্বনে নির্মিত দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ বক্স অফিসে ৪৬০ কোটি ইউয়ান আয় করে—চীনা সাই-ফাই সিনেমাকে এনে দেয় নবযুগের সূচনা।
অভিনন্দন জানাতে গিয়ে পরিচালক গুয়ো ফান বলেছিলেন, “আমাদের এই কল্পনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন মহাকাশে কর্মরত বাস্তব মানুষগুলো।”
কল্পনা থেকে কারখানায়: বাস্তবের সাই-ফাই
আজ সেই চলচ্চিত্রের ধারণাগুলো বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। “দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ ২”-এ দেখা এক্সোস্কেলেটন বা যান্ত্রিক পোশাক এখন বাজারে পাওয়া যায়, ব্যবহৃত হচ্ছে খনি, জ্বালানি, এমনকি পর্যটন শিল্পেও। ফুজিয়ানের উয়িশান পাহাড়ে পর্যটকেরা এখন ভাড়া নিতে পারেন এই যান্ত্রিক ডিভাইস—মাত্র ৯৮ ইউয়ানে তিন ঘণ্টার জন্য।
আরেকদিকে “অদৃশ্য চাদর” আর কেবল কল্পনা নয়—চীনা গবেষকেরা ইতিমধ্যে এমন মেটাম্যাটেরিয়াল তৈরি করেছেন যা আলো ও মাইক্রোওয়েভ বাঁকাতে সক্ষম। ২০২৩ সালে উহান টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি প্রদর্শন করেছিল এমন ইউনিফর্ম যা ইনফ্রারেড ডিটেকশন থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারে।
এমন উদ্ভাবন শুধু প্রযুক্তিতে নয়, প্রতিরক্ষা খাতেও এসেছে। ২০২৫ সালের সামরিক কুচকাওয়াজে আকাশে ওড়ানো জে-৩৫এ ও জে-২০সহ পাঁচটি স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রমাণ করেছে—বিজ্ঞান কল্পনার অনেক দৃশ্যই এখন চীনের দৈনন্দিন বাস্তবতা।
চীনের ধারাবাহিক উদ্ভাবনমূলক নীতিই এই অগ্রগতির ভিত্তি। বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে এখন চীনের অবস্থান ১১তম, এবং পেটেন্ট আবেদন সংখ্যায় দেশটি বিশ্বের শীর্ষে।
চীনা হৃদয়ে মহাবিশ্বের গল্প
চীনা পরিচালক গুয়ো ফান মজা করে একবার বলেছিলেন, “চীনারা পৃথিবীসহ পালাবে, কারণ আমাদের ঘর এখানে।” এই একটি বাক্য যেন চীনা সাই-ফাইয়ের মূল সুর—প্রযুক্তির সঙ্গে গভীর মানবিক টান।
বেইজিংয়ের শোগাং পার্কে গড়ে তোলা ‘SoReal Sci-Fi Park’ এখন সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক। ২০২৪ সালে চীনের সাই-ফাই শিল্পের রাজস্ব ছুঁয়েছে ১০৮.৯৬ বিলিয়ন ইউয়ান—প্রমাণ করে, এটি আর ‘নিশ জঁর’ নয়, বরং অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।

লেখক চেন চিউফান বলেন, “বিজ্ঞান কল্পনা এক সার্বজনীন ভাষা—এটি শুধু বিশ্বকে চীনকে বুঝতে সাহায্য করছে না, বরং চীনকেও নিজের গল্প বিশ্বকে বলতে দিচ্ছে।”
অন্যদিকে সাই-ফাই লেখক হান সং মনে করেন, “আগামী সাই-ফাই যুগ হবে পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে—চীনের সিনেমা যাবে চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ পর্যন্ত, এমনকি অন্ধকার পদার্থের গভীরেও।”
চীনের শতবর্ষের এই সাই-ফাই যাত্রা তাই কল্পনা নয়, বাস্তবতার প্রতিফলন—যেখানে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা একসঙ্গে গড়ে তুলছে ভবিষ্যতের মহাকাব্য।
#চীনা_সাইফাই #TheWanderingEarth #LiuCixin #ScienceFiction #Sarakhon #ThePresentWorld #ChineseCinema #Technology #Culture #Innovation
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















