বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ আর কোনো সম্পাদকীয় বা বিজ্ঞাপনে পশমজাত পণ্য ব্যবহার করবে না। তাদের মূল প্রতিষ্ঠান কন্ডে ন্যাস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী পশম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকবে—যা বিশ্ব ফ্যাশন জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা
বিশ্ববিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ আর কোনো সম্পাদকীয় বা বিজ্ঞাপনে নতুন পশমজাত (animal fur) পণ্য প্রদর্শন করবে না। তাদের মূল প্রতিষ্ঠান কন্ডে ন্যাস্ট (Condé Nast) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নতুন নীতিমালায় এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, “শুধুমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে স্থানীয় বা আদিবাসী জীবনধারা ও উপার্জনের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত পশমজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।” এই নীতি শুধু ভোগ-এর জন্য নয়, বরং কন্ডে ন্যাস্টের অন্যান্য জনপ্রিয় ম্যাগাজিন—যেমন দ্য নিউ ইয়র্কার, ভ্যানিটি ফেয়ার এবং জিকিউ—এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
ফ্যাশন জগতে পশমের প্রতি বিরোধ
ফ্যাশন দুনিয়ায় পশমের ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর জনপ্রিয়তা নাটকীয়ভাবে কমেছে। ২০১০-এর দশক থেকেই কানাডা গুজ, গুচি, প্রাডা, ভার্সাচে, মাইকেল করস এবং নেট-এ-পোর্টারের মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো ঘোষণা দেয় যে তারা পশমজাত পণ্য ধীরে ধীরে বাজার থেকে সরিয়ে নেবে।
২০২১ সালে এল ম্যাগাজিনও ঘোষণা দেয় যে, তাদের সব আন্তর্জাতিক সংস্করণে পশম নিষিদ্ধ করা হবে—প্রাণীকল্যাণ রক্ষার স্বার্থে এবং আধুনিক পাঠকের রুচির প্রতিফলন হিসেবে। অনেক দেশেই ইতোমধ্যে পশম খামার নিষিদ্ধ হয়েছে, যেমন যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ইতালি ও নরওয়ে। ২০২১ সালে ইসরায়েল প্রথম দেশ হিসেবে নতুন পশম বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় “ফার ট্রেন্ড” ও বিতর্ক
তবে ২০২৪ সালে টিকটকে “মব ওয়াইভস” নামের এক স্টাইল ট্রেন্ড হঠাৎ জনপ্রিয়তা পায়, যেখানে বিশাল পশম কোট, প্রাণীপ্রিন্ট, সোনার গয়না ও চকচকে চামড়ার প্যান্ট ফ্যাশনে ফিরে আসে। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পশমের প্রতি আগ্রহ কিছুটা বাড়ে।
তখন ভোগ একাধিক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে—যেখানে এই নতুন ট্রেন্ডের নৈতিক দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “ফার ফিরে এসেছে। এটাই সমস্যার।” আরেকটি প্রতিবেদনে জিজ্ঞেস করা হয়, “পুরনো পশম (vintage fur) পরা কি এখন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য?”
নয় মাসের প্রচারণার ফল
কন্ডে ন্যাস্টের এই নীতি পরিবর্তন হঠাৎ নয়। এটি এসেছে প্রাণী অধিকার সংগঠন কোয়ালিশন টু অ্যাবলিশ দ্য ফার ট্রেড (CAFT)-এর নয় মাসব্যাপী এক প্রচারণার ফল হিসেবে।
এই সময় প্রাণী অধিকার কর্মীরা লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে ভোগ-এর সম্পাদকদের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করেন, এবং ম্যাগাজিন আয়োজিত ইভেন্টগুলোতেও প্রতিবাদ জানান। তারা এমনকি আমেরিকান গার্ল নামের একটি পুতুল ব্র্যান্ডের দোকানেও বিক্ষোভ করেন—যার পরিচালনা পর্ষদে কন্ডে ন্যাস্টের প্রধান নির্বাহী রজার লিঞ্চ আছেন।
রবিবার সিএএফটি এক বিবৃতির মাধ্যমে জানায়, তাদের এই ধারাবাহিক আন্দোলনের পর অবশেষে কন্ডে ন্যাস্ট প্রকাশনাগুলো থেকে পশম তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পশম শিল্পের নেপথ্যের বাস্তবতা
প্রাণী অধিকার সংস্থা হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল-এর তথ্য অনুযায়ী, যদিও অনেক দেশে পশম খামার নিষিদ্ধ, তবুও প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ প্রাণী শুধুমাত্র পশমের জন্য হত্যা করা হয়। অধিকাংশ প্রাণী সংকীর্ণ খাঁচায় বন্দি অবস্থায় থাকে এবং অমানবিক অবস্থায় পালিত হয়।
আনা উইনটোর ও পুরনো বিতর্ক
দীর্ঘদিন ভোগ-এর সম্পাদক-প্রধান থাকা আনা উইনটোর পশমপ্রেমের জন্য বহুবার সমালোচিত হয়েছেন। ২০০৫ সালে এক প্রাণী অধিকার কর্মী তাঁকে টফু পাই দিয়ে আঘাত করেছিলেন।
২০১৯ সালে সিএনএন-এর সাংবাদিক ক্রিশ্চিয়ান আমানপুরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উইনটোর বলেন, “নকল পশম (fake fur) আসলে বাস্তব পশমের চেয়ে পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিকর।”
তাঁর ভাষায়, “মানুষ এখন পুনঃব্যবহার বা আপসাইক্লিং নিয়ে ভাবছে। আগের ব্যবহৃত পশম বা কাপড়কে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব। তবে যেসব ফ্যাশন হাউস এখনও পশম ব্যবহার করে, তাদের নৈতিক মানদণ্ড কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত।”
কন্ডে ন্যাস্টের এই সিদ্ধান্ত শুধু ফ্যাশন জগতেই নয়, বরং গণমাধ্যমেও এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রতীক। ভোগ-এর মতো প্রভাবশালী প্রকাশনা যখন পশমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তখন তা শিল্পের নৈতিক বিবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত দেয়—যেখানে ফ্যাশন কেবল সৌন্দর্যের নয়, বরং দায়িত্ব ও সচেতনতারও প্রতিফলন।
#ভোগ #কন্ডেন্যাস্ট #ফ্যাশন #পশমনিষিদ্ধ #প্রাণীঅধিকার #সারাক্ষণরিপোর্ট