স্ক্রিন ক্লান্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের চাপ থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বজুড়ে তরুণরা ফিরছে পুরনো যুগে—ফ্লিপ ফোন, সিডি আর ডিজিটাল ক্যামেরার জগতে। সীমিত প্রযুক্তিতেই তারা খুঁজে নিচ্ছে মানসিক প্রশান্তি ও বাস্তব জীবনের নিয়ন্ত্রণ।
পুরনো প্রযুক্তির প্রতি নতুন আকর্ষণ
২০২৫ সালের তরুণরা আবার ফিরে যাচ্ছে পুরনো দিনে—ফ্লিপ ফোন, সিডি ও ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে। আধুনিক স্মার্টফোনের বদলে অনেকেই বেছে নিচ্ছে সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস, যাতে শুধু কল করা ও টেক্সট পাঠানো যায়। কলেজ শিক্ষার্থী লুসি জ্যাকসনের মতো অনেকে বলছেন, এতে জীবন একটু জটিল হয় ঠিকই, কিন্তু মানসিক প্রশান্তি মেলে।
লুসি এখন কাগজের মানচিত্র ব্যবহার করেন, রাইড শেয়ার অ্যাপ নয়—সরাসরি ক্যাব কোম্পানিতে ফোন দেন। তাঁর কথায়, “সবকিছু হাতের নাগালে না থাকলে জিনিসের প্রতি কৃতজ্ঞতা বাড়ে।”
স্ক্রিন ক্লান্তি ও নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা
আজকের কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির মধ্যেই বড় হয়েছে—ফোনে মিডিয়া দেখা, অ্যাপে খাবার অর্ডার করা, কিংবা রাইডশেয়ার ব্যবহার করা ছিল তাদের দৈনন্দিন বিষয়। কিন্তু একাংশ এখন এসব থেকে মুক্তি চায়। তারা মনে করছে—ডিজিটাল দুনিয়া তাদের জীবন থেকে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছে। সেই হারানো নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে তারা পুরনো প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে।
‘লাডাইট ক্লাব’ নামের এক অলাভজনক সংগঠন এখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ২৬টি অধ্যায়ে সক্রিয়, যার সদস্যদের লক্ষ্য হলো “স্মার্টফোন থেকে বিরতি নেওয়া।” এই ক্লাবের বোর্ড সদস্য লুসি জ্যাকসনই তরুণ প্রজন্মের এমন পরিবর্তনের অন্যতম মুখ।
পুরনো মাধ্যমে সঙ্গীত শোনা: সিডির পুনর্জাগরণ
সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে পুরনো সিডির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। টেইলর সুইফট, সাবরিনা কার্পেন্টার ও লাউফির মতো শিল্পীরা এখন আবার সিডি, ভিনাইল রেকর্ড ও টেপ বিক্রি করছেন—কখনও একক গান হিসেবেও। অ্যামাজনের সিডি চার্টে সাম্প্রতিক সময়ে এই তরুণ শিল্পীরাই শীর্ষে।
২৫ বছর বয়সী ডেটা ইঞ্জিনিয়ার হান্টার হোয়াইট বলেন, “আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি এমন এক পৃথিবীতে যেখানে কিছুই আমাদের নিজের নয়।” স্ট্রিমিং সেবাগুলোর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে তিনি এখন সিডি সংগ্রহ করেন, কারণ তাঁর মতে এই প্ল্যাটফর্মগুলো শিল্পীদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দেয় না।
তিনি গ্যারেজ সেল, পুরনো দোকান, রেকর্ড স্টোর ও স্থানীয় ইভেন্ট থেকে সিডি কেনেন এবং শুনতে ব্যবহার করেন ২০০২ সালের একটি পুরনো সনি প্লেয়ার।
নতুন যুগে পুরনো অ্যাপ: ‘ডিসোন্যান্ট’
নিজের মতো তরুণদের জন্য হোয়াইট একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন—‘ডিসোন্যান্ট’। সদস্যরা এখানে সিডি অর্ডার করতে পারে ডাকযোগে, সঙ্গে থাকে হাতে লেখা অ্যালবামের নোট। চাইলে তারা অ্যালবামটি রেখে দিতে পারে, অথবা ফিরিয়ে দিয়ে নতুনটি নিতে পারে। বর্তমানে অ্যাপটিতে ৮০০টির বেশি সিডি ও প্রায় ৩৫০ জন সদস্য রয়েছে।
প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের ক্লান্তি
২০২৩ সালের হ্যারিস পোল জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ তরুণ মনে করে যুব সমাজ প্রযুক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ৬০ শতাংশের ইচ্ছে, “সবাই ডিজিটাল জগতে ঢোকার আগের সময়টিতে ফিরে যাওয়া।”
গবেষক ক্লে রাউটলেজ বলেন, “তারা প্রযুক্তি পছন্দ করে, কিন্তু একই সঙ্গে অনুভব করে কিছু যেন হারিয়ে যাচ্ছে—তাই তারা প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ ফেরত চায়।”
বাস্তব জীবনে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা
লুসি স্মরণ করেন, মাধ্যমিকে তাঁর প্রথম আইফোন হাতে পেয়ে যেন তিনি দুই জীবন যাপন করতেন—একটি বাস্তব, আরেকটি সামাজিক মাধ্যমের সাজানো ভার্চুয়াল জীবন। পরে যখন তিনি ফ্লিপ ফোন ব্যবহার শুরু করেন, তাঁর জীবন বদলে যায়।
“সঙ্গীত শোনা, মানচিত্র দেখা, এমনকি পড়াশোনার ধরনও পাল্টে গিয়েছিল,” তিনি বলেন। “সবকিছুই অনেক বেশি সচেতনভাবে করতে হতো।”
ডিজিটাল ক্যামেরার নতুন উত্থান
‘পয়েন্ট-অ্যান্ড-শুট’ ডিজিটাল ক্যামেরা এখন তরুণদের কাছে আবার আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। টিকটকে এমন এক রসিকতা জনপ্রিয় যে, প্রতিটি বন্ধুবৃত্তে একজন থাকে ‘ডিজিটাল ক্যামেরা ফ্রেন্ড’, যার কাজ সবাইকে একত্র করে ছবি তোলা। এমনকি মডেল কেন্ডাল জেনারও সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে একটি ক্যানন পাওয়ারশট হাতে ছবি পোস্ট করেছেন।
শিকাগোর ২৬ বছর বয়সী তুমাসি আগিয়াপং জানান, তিনি দুই বছর আগে এই ক্যামেরায় আগ্রহী হন। এখন তাঁর কাছে রয়েছে ১৫টি ক্যামেরা। “স্মার্টফোনের নেশা থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখতেই আমি ক্যামেরা ব্যবহার শুরু করেছি,” বলেন তিনি।
পুরনো প্রযুক্তিতে নতুন স্বাধীনতা
আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে পুরনো প্রযুক্তি শুধু নস্টালজিয়ার বিষয় নয়; বরং এটি এক ধরনের স্বাধীনতার প্রতীক। সীমাবদ্ধতাই তাদের কাছে এখন মুক্তির উপায়—যেখানে স্ক্রিনের দাস না হয়ে, তারা নিজের সময়, ছবি, সঙ্গীত ও বাস্তবতাকে নতুন করে আবিষ্কার করছে।
#টেক_সংস্কৃতি #তরুণ_প্রজন্ম #সিডি_ফিরে_আসছে #ডিজিটাল_ক্যামেরা #লাডাইট_ক্লাব #সারাক্ষণ_রিপোর্ট