রাজধানী থেকে গ্রাম—দেশের প্রতিটি বাজারেই এখন নিত্যপণ্যের দামে আগুন। সবজি, মাছ, মাংস, চাল, ডিম কিংবা তেল—কোনো কিছুই হাতের নাগালে নেই। একসময় যে পণ্যকে প্রতিদিনের খাদ্য বলা হতো, তা এখন বিলাসবস্তুতে পরিণত হয়েছে। মগবাজারের রিকশাচালক নূর হোসেনের কথায়,
“আগে বাজারে গেলে বউকে বলতাম কী আনব, এখন বলি—কী বাদ দেব!”
সবজির বাজারে আগুন: চার পদের সবজি কিনতেই ৩০০ টাকা
ঢাকা শহরের বাজারগুলোয় এখন সবচেয়ে বেশি ধাক্কা সবজির দামে। কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মগবাজার ও যাত্রাবাড়ী ঘুরে দেখা গেছে—সবজির কেজি ৬০ টাকার নিচে কোনো পণ্যই নেই।
সবজি | বর্তমান দাম (প্রতি কেজি) | গত মাসের তুলনায় বৃদ্ধি |
বেগুন | ১২০–১৪০ টাকা | ২৫ টাকা |
করলা | ৮০–৯০ টাকা | ২০ টাকা |
চিচিঙ্গা / ঝিঙে | ৭০–৮০ টাকা | ১৫ টাকা |
ঢ্যাঁড়স | ৯০–১০০ টাকা | ২৫ টাকা |
পটল / কাঁকরোল | ৮০–৯০ টাকা | ২০ টাকা |
টমেটো (আমদানি) | ১০০–১২০ টাকা | ৩০ টাকা |
আলু | ২৫–৩০ টাকা | স্থিতিশীল |
পেঁপে | ৩০–৪০ টাকা | সামান্য বৃদ্ধি |
পেঁয়াজ | ৭৫–৮৫ টাকা | ১০ টাকা |
বৃষ্টির কারণে মাঠে ফসলের সরবরাহ কমে গেছে, পাশাপাশি দুর্গাপূজার ছুটিতে ভারত থেকে সবজি আমদানিও ব্যাহত হয়েছে। ফলে বাজারে চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে দাম লাফিয়ে বেড়েছে।
ক্রেতার কণ্ঠ:
“আগে হাজার টাকায় এক সপ্তাহের সবজি হতো, এখন দেড় হাজার টাকাতেও কুলায় না,”—বললেন গৃহিণী রুমা আক্তার।
“সবজির দোকানে এখন দাম জিজ্ঞেস করাটাই লজ্জার, বিক্রেতা এমনভাবে তাকায় যেন অপরাধ করছি,”—হাসতে হাসতে বললেন রিকশাচালক নূর হোসেন।
মাছে-মাংসে মানুষের পরাজয়
একসময় যে জাতিকে বলা হতো ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’, সে এখন মাছের বাজারে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দাম বেড়েছে প্রায় সব মাছেরই।
মাছ | বর্তমান দাম (প্রতি কেজি) | পূর্বের দাম |
রুই / কাটলা | ৩৮০–৪০০ টাকা | ৩২০–৩৫০ টাকা |
তেলাপিয়া | ২৫০–২৮০ টাকা | ২০০–২২০ টাকা |
কই | ২৬০–২৮০ টাকা | ২২০–২৪০ টাকা |
পাঙ্গাশ | ২০০–২৫০ টাকা | ১৮০–২০০ টাকা |
ইলিশ | ১,৮০০–২,২০০ টাকা | ১,৪০০–১,৬০০ টাকা |
সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও বৃষ্টির কারণে মাছ পরিবহন খরচ বেড়েছে। ফলে পাইকারি বাজার থেকে খুচরায় দাম প্রায় ১৫–২০ শতাংশ বেশি পড়ছে।
ক্রেতার কণ্ঠ:
“আগে সপ্তাহে একদিন ইলিশ খেতাম, এখন শুধু তাকিয়ে দেখি,”—বললেন পুরান ঢাকার দোকান কর্মচারী সোহেল মিয়া।
“মাছ কিনতে গিয়ে এখন মুরগি নেওয়াই সহজ মনে হয়,”—মন্তব্য করলেন গৃহিণী ফেরদৌসি বেগম।
মুরগি, ডিম ও মাংস: বিকল্প নেই, দামেও রেহাই নেই
টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১৫ টাকা এবং ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে।
পণ্য | বর্তমান দাম | মন্তব্য |
ব্রয়লার মুরগি | ১৮০–২০০ টাকা | ১৫ টাকা বেড়েছে |
সোনালি / দেশি মুরগি | ৩০০–৩২০ টাকা | দাম অপরিবর্তিত উচ্চ পর্যায়ে |
ডিম (ডজন) | ১৪০–১৪৫ টাকা | সামান্য কমলেও এখনও বেশি |
গরুর মাংস | ৭৫০–৮০০ টাকা | তিন মাস ধরে স্থায়ী উচ্চমূল্য |
খাসির মাংস | ১,১০০–১,২০০ টাকা | রেকর্ড দাম |
হাঁসের মাংস | ৩২০–৩৫০ টাকা | বাজারে সরবরাহ সীমিত |
ক্রেতার কণ্ঠ:
“আগে সপ্তাহে দুই দিন মুরগি রান্না হতো, এখন একদিনও ভাবতে হয়,”—বললেন ধানমন্ডির কলেজশিক্ষার্থী নুসরাত জাহান।
“ডিমই এখন গরিবের একমাত্র মাংস,”—চোখ মুছলেন পোশাকশ্রমিক পারভিন আক্তার।
চালের বাজার: গৃহস্থের সবচেয়ে বড় বোঝা
বাংলাদেশে চাল শুধু খাবার নয়, এটি জীবনযাত্রার প্রতীক। কিন্তু এখন সেই চালই মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
চালের ধরন | দাম (প্রতি কেজি) | মন্তব্য |
মিনিকেট | ৮৫–৯০ টাকা | আগের মাসের তুলনায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি |
পাজাম / আটাশ | ৬৫–৭০ টাকা | নিম্নবিত্তের ভরসা |
মোটা চাল (গুটিস্বর্ণ) | ৫৫–৬০ টাকা | টিসিবির বিক্রয়েও ভিড় |
পোলাও চাল | ১২০–১৩০ টাকা | ধনীদের বিলাসপণ্য |
অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে গড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। উৎপাদন খরচ, সার-বীজের দাম, পরিবহন খরচ এবং সিন্ডিকেট—সব মিলিয়ে এই পণ্যের দামে লাগাম নেই।
ভোক্তার কণ্ঠ:
“চাল কিনতেই মাসের অর্ধেক বেতন চলে যায়,”—বললেন মিরপুরের শিক্ষক গোলাম মোস্তফা।
“মিনিকেটে হাত দেওয়া মানে বিলাসিতা, এখন মোটা চালই খাই,”—হাসলেন ব্যাংককর্মী আরিফুল ইসলাম।
ডাল, তেল, মসলা ও তৎসংশ্লিষ্ট পণ্য: চাপের পর চাপ
চাল-সবজির মতোই ডাল ও তেলবাজারেও বৃদ্ধি অব্যাহত।
পণ্য | দাম | মন্তব্য |
মসুর ডাল | ১৩০–১৪০ টাকা | স্থায়ীভাবে উচ্চমূল্য |
মুগ ডাল | ১৫০–১৬০ টাকা | ঘাটতির কারণে দাম স্থির উচ্চ |
ছোলা | ১৪০–১৫০ টাকা | রোজা-পরবর্তী সময়েও দাম কমেনি |
সয়াবিন তেল | ১৮৫–১৯০ টাকা / লিটার | স্থিতিশীল কিন্তু ব্যয়বহুল |
রসুন | ২০০–২৪০ টাকা | আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি |
আদা | ১৫০–১৮০ টাকা | টানা উচ্চমূল্যে বিক্রি |
লবণ | ৫০–৫৫ টাকা | সামান্য বৃদ্ধি |
বিক্রেতার কণ্ঠ:
“আমরাও অসহায়, পাইকারি বাজারে যেভাবে পাই, সেভাবেই বিক্রি করি,”—বললেন মিরপুরের মুদি দোকানদার সালাম শেখ।
ফুলের বাজারেও ঝলকানি নেই
রাজধানীর শাহবাগ ফুলবাজারে গোলাপের ৫০-টি ফুলের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল ১৪০ টাকা। গাঁদা, জুঁই, রজনীগন্ধার দামে ৬০–৭০ শতাংশ বৃদ্ধি।
ফুল বিক্রেতা হুমায়ুন কবিরের অভিমত:
“আমরা বিক্রেতারা লাভ করছি না, পাইকারি দামে ফুল আনতেই খরচ বেড়ে গেছে। উৎসব না হলে বিক্রি কম, কিন্তু খরচ আগুন।”
বাজারের মানুষের কণ্ঠ
“বাজারে গেলে এখন মনে হয় যুদ্ধ করতে যাচ্ছি,”—রবিউল ইসলাম, মুদি দোকানদার, কেরানীগঞ্জ।
“একটা ছোট পরিবার চালাতে দুইজনের উপার্জনও যথেষ্ট না,”—ফারজানা ইয়াসমিন, অফিসকর্মী, গুলশান।
“একটা সবজির থলে নিয়ে ফিরলে মনে হয় সোনা কিনে এনেছি,”—জুবায়ের হোসেন, ছাত্র, টঙ্গী।
“ডিম কিনে বাড়ি ফেরার সময় মনে হয় বিলাসপণ্য হাতে নিয়েছি,”—সালমা বেগম, বস্তিবাসী, শ্যামপুর।
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ: কেন থামছে না দাম
বাংলাদেশ ব্যাংক ও পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুসারে—
- সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি: ৮.৩৬ শতাংশ
- খাদ্য মূল্যস্ফীতি: ৯.০ শতাংশ
- অখাদ্য খাতে: ৮.৯৮ শতাংশ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই “দ্বিগুণ ধাক্কা” (Dual Inflation Shock) মূলত তিন কারণে ঘটছে:
১. সরবরাহ শৃঙ্খলার দুর্বলতা: কৃষি ও আমদানির সরবরাহ চেইন বারবার ভেঙে পড়ছে।
২. মুদ্রার অবমূল্যায়ন: ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
৩. সিন্ডিকেট ও মজুদদারি: কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন,
“মূল্যবৃদ্ধি এখন শুধুই অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। আয় ও ব্যয়ের ফারাক মানুষকে ক্রমে দরিদ্রতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
#দ্রব্যমূল্য #মূল্যবৃদ্ধি #বাজারসংকট #বাংলাদেশঅর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট