একজন ভালো ব্যবস্থাপক কেমন? নেতৃত্ব, সহানুভূতি, বুদ্ধিমত্তা—এসব আমরা জানি। কিন্তু একটি গুণ আছে, যেটি অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে—মানুষের সক্ষমতা বুঝে তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ নির্ধারণ করা। এই গুণটিই একটি বড় বহুজাতিক কোম্পানির ১০ বছরের গবেষণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কর্মীদের যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক দায়িত্বে নিয়োগ দিতে পারেন বা তাদের সেই পথে উৎসাহ দেন, তারাই প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে সফল করেন।
গবেষণার পরিধি ও ফলাফল
গবেষণাটি ১০০টি দেশে ছড়িয়ে থাকা ২ লাখ কর্মী ও ৩০ হাজার ম্যানেজারকে নিয়ে পরিচালিত হয়। এতে দেখা গেছে, সেরা ম্যানেজাররা কেবল, দলের কর্মদক্ষতা বাড়াননি, বরং মানুষকে তাদের উপযুক্ত কাজের জায়গায় পুনর্বিন্যাস করে দিয়েছেন।
ফলাফল ছিল বিস্ময়কর—এই পরিবর্তনের ফলে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা ও আয় দুই-ই বেড়েছে, এবং এর প্রভাব বহু বছর ধরে স্থায়ী হয়েছে।
শীর্ষ ম্যানেজার চিহ্নিত করার পদ্ধতি
গবেষকরা প্রথমে দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া ম্যানেজারদের চিহ্নিত করেন। সাধারণত এদের বেতন বৃদ্ধি, পারফরম্যান্স রেটিং ও অন্যান্য মাপকাঠিতেও তারা এগিয়ে থাকেন। এভাবে মোট ম্যানেজারদের প্রায় এক-চতুর্থাংশকে ‘শীর্ষ পারফর্মার’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
এরপর দেখা হয়—এই দুই ধরনের ম্যানেজার যখন রোটেশন প্রক্রিয়ায় নতুন দলে যোগ দেন, তখন তাদের অধীনে কাজ করা কর্মীদের পারফরম্যান্সে কী পরিবর্তন আসে।
উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন
দুই সমমানের দলের মধ্যে একটি যদি সাধারণ ম্যানেজারের অধীনে থাকে এবং অন্যটি শীর্ষ ম্যানেজারের অধীনে যায়, তবে পরের দলের কর্মীরা প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি হারে সংস্থার অভ্যন্তরে নতুন দায়িত্ব বা বিভাগে স্থানান্তরিত হন।
এই স্থানান্তরগুলো তুচ্ছ ছিল না—অনেকে, পুরোপুরি ভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে চলে যান। ফলস্বরূপ, এই কর্মীরা ৭ বছরের মধ্যে অন্যদের তুলনায় গড়ে ১৩ শতাংশ বেশি আয় করেছেন এবং তাদের উৎপাদনশীলতা (যেমন বিক্রয় পরিমাণ) ছিল ১৬ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কাজ পরিবর্তন করাটাই প্রায় ৬৪ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির ব্যাখ্যা দেয়। আর শীর্ষ ম্যানেজাররাই মূলত মানুষকে সেই পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করেন।
প্রভাবের স্থায়িত্ব ও ব্যাখ্যা
এই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার কারণও গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো ম্যানেজার শুধু ভালো কোচ হতেন, তবে তার অধীনে থাকাকালীন উন্নতি দেখা যেত, কিন্তু পরে তা হারিয়ে যেত। বাস্তবে দেখা গেছে, উৎপাদনশীলতা ও বেতন বৃদ্ধি ম্যানেজার বদলের পরও অব্যাহত থেকেছে।
তাছাড়া, শীর্ষ ম্যানেজাররা কেবল শেখাননি—তারা কর্মীদের এমন নতুন ভূমিকা খুঁজে পেতে সহায়তা করেছেন, যেখানে তাদের যোগ্যতা ও আগ্রহ আরও ভালোভাবে কাজে লেগেছে।
কর্মীদের উৎসাহিত করার কৌশল
গবেষণায় দেখা গেছে, সেরা ম্যানেজাররা সাধারণের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি সময় একান্ত বৈঠকে ব্যয় করেছেন। তারা শুধু প্রতিক্রিয়া দেননি, বরং কর্মীদের দক্ষতা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন সুযোগ তৈরি করেছেন।
তাদের অধীনে কর্মীরা প্রায় ১০ শতাংশ বেশি হারে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জব-ম্যাচিং প্ল্যাটফর্মে প্রোফাইল সম্পন্ন করেছেন এবং ৫০ শতাংশ বেশি হারে নতুন প্রকল্প বা স্বল্পমেয়াদি দায়িত্ব নিয়েছেন।
একজন কর্মী জানিয়েছেন, তার ম্যানেজার এক উপস্থাপনার সময় তার গ্রাফিক ডিজাইনের আগ্রহ লক্ষ্য করে তাকে একটি নতুন প্রচারণার ডিজাইন টিমে যুক্ত করেন। অন্যজন ডিজিটাল মার্কেটিং শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ম্যানেজার তার জন্য ক্রস-ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন, যা পরে তাকে উপযুক্ত নতুন পদে স্থান করে দেয়।
সংস্থার করণীয়
এই গবেষণা ইঙ্গিত দেয়—কোম্পানিগুলোকে ম্যানেজারদের মূল্যায়ন করতে হবে শুধু দলের পারফরম্যান্সে নয়, বরং তারা কর্মীদের উন্নয়নে কতটা অবদান রাখছেন তার ভিত্তিতে।
মানবসম্পদ বিভাগ নয়, বরং প্রত্যেক ম্যানেজারকেই কর্মীদের দক্ষতা চিহ্নিত করে উপযুক্ত জায়গায় বসানোর দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানের উচিত এমন ব্যবস্থা রাখা, যাতে কর্মী ও ম্যানেজাররা সহজে বিভাগ পরিবর্তন বা নতুন ভূমিকা নিতে পারেন।
সেরা ম্যানেজাররা জানেন—সঠিক মানুষকে সঠিক স্থানে বসানোই দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের মূল। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এই দক্ষতাকে স্বীকৃতি ও পুরস্কার দেয়, তবে তারা শুধু উৎপাদনশীলতা নয়, কর্মীদের সম্ভাবনাও বহুগুণে বাড়াতে পারবে।