ঐতিহাসিক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত
মিশরের শার্ম আল-শেখ শহরে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন। দুই বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে তিনি এটিকে “মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ঐতিহাসিক ভোর” বলে অভিহিত করেন। ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, কাতার ও তুরস্কের সমন্বয়ে এক “গ্যারান্টি ডকুমেন্ট” স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতির কার্যকর বাস্তবায়নের ঘোষণা আসে।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ
এই সম্মেলনে ২৭টি দেশের নেতা ও কূটনীতিকরা অংশ নেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মানসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও জার্মানির প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাম্পের বক্তব্য: ‘দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের অবসান’
ইসরায়েলের পার্লামেন্টে (কনেসেট) ভাষণ দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, “এটি এমন এক মুহূর্ত যা আমার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। দুই বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসানে মানুষ আজ রাস্তায় নেচে উঠেছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমি বহু সাফল্যের সাক্ষী হয়েছি, কিন্তু আজকের মতো দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তাঁকে “ইসরায়েলের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে অভিহিত করেন।
মিশরের ভূমিকার প্রশংসা
ট্রাম্প মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, “সবাই বলেছিল এটি অসম্ভব, কিন্তু এটি এখন বাস্তবে ঘটছে। সিসি একজন গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গাজার শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন।”
সিসি পাল্টা মন্তব্যে ট্রাম্পকে “মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার একমাত্র ব্যক্তি” বলে আখ্যা দেন।
গাজা যুদ্ধবিরতির বিস্তারিত
এই চুক্তির আওতায় ইসরায়েল থেকে মুক্তি পেয়েছে বহু ফিলিস্তিনি বন্দি, একই সঙ্গে গাজা থেকে ফিরে এসেছে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলায় অপহৃত শেষ জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিরা। এছাড়া হামাসের হাতে নিহত ২৭ জন জিম্মি ও ২০১৪ সালের সংঘর্ষে নিহত এক ইসরায়েলি সৈন্যের দেহাবশেষও ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
রামাল্লা ও গাজা শহরে মুক্ত বন্দিদের স্বাগত জানাতে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পশ্চিম তীরের খান ইউনুস ও তেল আবিবের ‘হোস্টেজ স্কয়ার’-এ জনতা আনন্দে উল্লাস প্রকাশ করে।
ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির ইঙ্গিত
ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে ইরানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ শান্তিচুক্তির সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে অভিযান চালিয়েছি। এখন যদি তারা চায়, আমরাও আলোচনায় প্রস্তুত। শান্তিচুক্তি হলে তা গোটা অঞ্চলের জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
জাতিসংঘ ও যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “আমি সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি এই গতি ধরে রাখতে এবং তাঁদের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করতে। জাতিসংঘ বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ চালিয়ে যাবে।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার বলেন, “হামাসের অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ ও নিরস্ত্রীকরণের জন্য যুক্তরাজ্য তার উত্তর আয়ারল্যান্ড অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত।”
গাজা পুনর্গঠনের দীর্ঘ পথ
ট্রাম্প বলেন, “দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হয়েছে। গাজায় ব্যাপক পুনর্গঠনের প্রয়োজন—এখন সেখানকার অবস্থা পরিষ্কার করা, পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের সময়।” তিনি আরও বলেন, “শান্তি চুক্তির মাধ্যমে কেবল যুদ্ধ থামেনি, এটি গাজা ও ইসরায়েল—উভয় জাতির মানুষের জন্য নতুন আশার সূচনা।”
পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যতের দৃষ্টি
মিশর, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও তুরস্কের স্বাক্ষরিত গ্যারান্টি ডকুমেন্ট যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। যদিও হামাসকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তবে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাম্প বলেন, “এখন বলটা তেহরানের কোর্টে। আমরা প্রস্তুত, তারা যখন চাইবে তখনই এগোতে পারি।”
মানবিক বিজয়ের বার্তা
গাজা ও ইসরায়েলের রাস্তায় আজ শান্তির প্রতীক হিসেবে মুক্ত মানুষের হাসি, আলিঙ্গন আর আনন্দের কান্না। দীর্ঘ অস্থিরতার পর মধ্যপ্রাচ্য নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করছে—যেখানে যুদ্ধ নয়, সহযোগিতাই হবে আগামী দিনের মূলমন্ত্র।
#গাজা_যুদ্ধ #ট্রাম্প #শান্তি_চুক্তি #মধ্যপ্রাচ্য #মিশর #ইসরায়েল #ফিলিস্তিন #জাতিসংঘ #শার্ম_আল_শেখ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট