গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় অ্যানথ্রাক্স বা ‘তড়কা’ শনাক্তের পর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ’র) একটি গবেষণা দল আক্রান্ত এলাকাগুলোতে গিয়ে জরুরি কোয়ারেন্টাইন ঘোষণা, মৃত পশুর নিরাপদ দাফন এবং টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করার সুপারিশ করেছে। দলটি স্থানীয়ভাবে সংক্রমণের উৎস অনুসন্ধান করে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
দুই জেলায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্তের পর মাঠে নেমেছে গবেষণা দল
গাইবান্ধা ও রংপুরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্তের পর বিএইউ’র গবেষক দল বুধবার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন করে। তারা সংক্রমণ পরিস্থিতি, পশুর অবস্থা ও মানুষের সচেতনতার ওপর তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
গরুর কোয়ারেন্টাইন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদারের তাগিদ
গবেষণা দল জানিয়েছে, সংক্রমিত এলাকাগুলোতে কোয়ারেন্টাইন জোন ঘোষণা অপরিহার্য, যাতে সংক্রমিত গরু অন্য পশুর সংস্পর্শে না আসে। এ ছাড়া, আক্রান্ত গরু বা মৃতদেহ পরিবহন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার নির্দেশনার ওপর তারা জোর দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইন কার্যকর করা গেলে রোগের বিস্তার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
মৃত পশু সঠিকভাবে না ফেলা সংক্রমণের প্রধান কারণ
বিএইউ’র পরজীবীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুজ্জামান বলেন, “মৃত পশুর অযথা ফেলে দেওয়া বা ভুলভাবে দাফন করা অ্যানথ্রাক্স ছড়ানোর অন্যতম কারণ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আক্রান্ত মাটি ও পানি দীর্ঘ মেয়াদে সংক্রমণের উৎস হয়ে থাকতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, মৃত পশু ৬ থেকে ৮ ফুট গভীরে পুঁতে ফেলা ও দাফনের জায়গা চুন মেশানো পানি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।
টিকার অভাব ও কৃষকদের অজ্ঞতা
বেলকা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে অধ্যাপক শহিদুজ্জামান জানান, অনেক গরু অ্যানথ্রাক্সের টিকা পায়নি এবং অনেক কৃষক এখনো জানেন না কীভাবে মৃত বা অসুস্থ পশু নিরাপদে দাফন করতে হয়।
সম্প্রতি অ্যানথ্রাক্সের প্রকোপ বাড়ায় বিএইউ’র ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোঃ বাহানুর রহমান সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি মাঠ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
সংক্রমণের প্রকৃত উৎস: মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান
দলের তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধার কিশামত সদর গ্রামের মধ্যপাড়ায় এক নারী অসুস্থ গরুর মাংস বাড়িতে আনার পর অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হন। অন্য এক ব্যক্তি জবাইয়ের সময় সংক্রমিত গরুর রক্ত চোখে লাগায় তার চোখ ফুলে গিয়েছিল।
এ ছাড়া আরও ১১ জন সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে।
মৃত পশুর দাফনে অব্যবস্থা
গবেষণা দল দেখতে পায়, আক্রান্ত গরু ও ছাগলের মৃতদেহ কিছু ক্ষেত্রে অগভীর গর্তে পুঁতে ফেলা হয়েছে, আবার কিছু খোলা জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে। জবাই করা পশুর অবশিষ্টাংশও খোলা স্থানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
তারা সতর্ক করে বলেন, এসব অবশিষ্টাংশ বালুমিশ্রিত মাটিতে থাকলে বৃষ্টির পানি বা বন্যার স্রোতে তা নিকটবর্তী নদী— যেমন ঘাঘট নদী — দূষিত করতে পারে এবং অ্যানথ্রাক্স স্পোর ছড়িয়ে দিতে পারে।
ঘাসের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি
স্থানীয় কৃষকেরা নদীর তীর থেকে গরুর খাদ্য হিসেবে ঘাস কেটে আনেন। যদি সেই ঘাস দূষিত পানিতে ধোয়া হয়, তাহলে অ্যানথ্রাক্স স্পোর ঘাসে লেগে যায় এবং তা খাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ গবাদি পশুও আক্রান্ত হতে পারে।
মাঠ পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি চলছে
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বিপ্লব কুমার দে জানান, “টিকাদান কার্যক্রম চলছে। প্রতি বছর যদি সব গরুকে নিয়মিত টিকার আওতায় আনা যায়, তাহলে অ্যানথ্রাক্স পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে মাঠ পর্যায়ে আরও প্রশিক্ষিত কর্মী ও সরঞ্জাম প্রয়োজন।”
গবেষণা দলের সদস্য ও লক্ষ্য
বিএইউ’র গবেষণা দলে ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. আমিমুল এহসান ও অধ্যাপক ড. আজিমুন নাহার (মেডিসিন বিভাগ), অধ্যাপক ড. জাহান আরা বেগম (প্যাথলজি বিভাগ), অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন (মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ), অধ্যাপক ড. জায়েদুল হাসান (সদস্য সচিব) এবং সহকারী অধ্যাপক সাইফুর রহমান।
অধ্যাপক আমিমুল এহসান বলেন, “আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণের কারণ শনাক্ত করা এবং ভবিষ্যতে প্রতিরোধের কৌশল প্রস্তাব করা।”
গবেষক দল মানুষের ক্ষত, প্রাণীর রক্ত, মাটি, পানি ও ঘাসের নমুনা সংগ্রহ করেছে সংক্রমণের উৎস নির্ধারণ ও টিকাপ্রাপ্ত পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য।
তারা স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সহায়তায় কৃষকদের টিকা, মৃত পশুর নিরাপদ ব্যবস্থাপনা এবং জনস্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দিয়েছে।
#অ্যানথ্রাক্স,বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গরুর কোয়ারেন্টাইন, গাইবান্ধা, রংপুর, টিকাদান কর্মসূচি, প্রাণিসম্পদ, জনস্বাস্থ্য, সারাক্ষণ রিপোর্ট