চীনের গ্রামীণ অঞ্চলে শুরু হয়েছে এক নীরব পরিবর্তন। ‘ডিজিটাল মুলান’ নামে একটি কর্মসূচি হাজারো নারীকে আধুনিক প্রযুক্তি শেখাচ্ছে এবং তাদের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। এই উদ্যোগ শুধু নারীর আয় বাড়াচ্ছে না, সমাজে তাদের মর্যাদাও আরও দৃঢ় করছে।
নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত নারীর উন্নয়ন
চীনে এখন মানবাধিকার মানে শুধু আইন নয়—জীবনের নিশ্চয়তা। শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজ, বাসস্থান ও বার্ধক্যে সেবা—এই মৌলিক সুযোগগুলোকে দেশটি মানবাধিকারের মূল অংশ হিসেবে দেখছে। একসময় পশ্চিমা গণমাধ্যমে চীনের মানবাধিকারের সমালোচনা হলেও, বাস্তবে দেশটি এখন “বাঁচার অধিকার” এবং “উন্নয়নের অধিকার”-কেই সবচেয়ে বড় মানবাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে।
এক গ্রামের মেয়ের সাফল্যের গল্প
গানসু প্রদেশের ডংশিয়াং গ্রামের তরুণী মা লানহুয়া আগে কৃষিকাজ করতেন। ২০২০ সালের আগে তার নিজের নামে ব্যাংক কার্ডও ছিল না। পরে তিনি ‘ডিজিটাল মুলান হোমস্টে ম্যানেজার ট্রেনিং প্রজেক্ট’-এ যোগ দেন। সেখানে তিনি শেখেন আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা, মোবাইল ফটোগ্রাফি, ভিডিও সম্পাদনা ও অনলাইন বিক্রির কৌশল।
এখন তিনি নিজের হোমস্টে পরিচালনা করেন, অনলাইনে স্থানীয় ফল বিক্রি করেন এবং গ্রাম্য সংস্কৃতি তুলে ধরেন। রান্নাঘর ও ক্ষেতের সীমা পেরিয়ে আজ তিনি হয়ে উঠেছেন প্রকৃত ‘ডিজিটাল যুগের মুলান’।
‘ডিজিটাল মুলান’: প্রযুক্তির জোরে নতুন আত্মবিশ্বাস
চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, অ্যান্ট ফাউন্ডেশন এবং চায়না ফাউন্ডেশন ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে এই প্রকল্প চালাচ্ছে। এতে নারীরা শেখছেন অনলাইন যোগাযোগ, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার, পর্যটন খাতে কাজের দক্ষতা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা।
২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৬টি প্রদেশে ৮,৬০০ নারী এই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। মধ্য ও পশ্চিম চীনের কম সুযোগপ্রাপ্ত এলাকায় তৈরি হয়েছে এআই-নির্ভর কর্মসংস্থান কেন্দ্র, যেখানে নারীরা অনলাইন গ্রাহকসেবা, ডেটা কাজ ও কনটেন্ট পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে যুক্ত হয়েছেন।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা
অ্যান্ট ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭,৫০০ জন চাকরি পেয়েছেন, যার ৭০ শতাংশই নারী। তাঁদের মাসিক আয় এখন গড়ে ৩,০০০ ইউয়ানের বেশি—স্থানীয় গড় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এই অর্থনৈতিক সাফল্য নারীদের পারিবারিক অবস্থান ও সমাজে অংশগ্রহণ উভয়ই বৃদ্ধি করেছে।
গ্রামীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ওয়াং জুন বলেন, ‘যেসব নারী এখন কাজ বা ব্যবসায় যুক্ত, তারা সন্তানদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করছেন এবং স্থানীয় সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
রাষ্ট্রীয় নীতি ও সহায়তা
চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘নারীর সার্বিক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে নারীর কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ বেড়ে হয়েছে ৪৩ শতাংশ। এছাড়া ৮.৪৯ মিলিয়ন নারী উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬৪০ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার) ঋণ সহায়তা।
বিশ্বের নজরে ‘শি পাওয়ার’
‘ডিজিটাল মুলান’ প্রকল্প এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো হুনান প্রদেশে এই প্রকল্প পর্যালোচনা করে এবং একে ‘বিশ্বের জন্য শেখার উপযুক্ত উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করে।
২০১৮ সাল থেকে চীন নারী ও শিশুদের উন্নয়ন নিয়ে ১০০টির বেশি প্রশিক্ষণ প্রকল্প চালু করেছে। ৪,০০০-এর বেশি নারী নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা তহবিলের সহায়তায় ২০টির বেশি দেশে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে।
ভবিষ্যতের দিশা
বেইজিংয়ে আয়োজিত ‘গ্লোবাল লিডার্স মিটিং অন উইমেন’-এ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নারীর অধিকার রক্ষায় ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে চারটি প্রস্তাব দেন।
মা লানহুয়া ও লিউ ইউ’র মতো নারীরা বলছেন—তাদের জীবন এখন অনেক উজ্জ্বল। লিউ বলেন, ‘আমি একদিন নিজের হোমস্টে খুলব—একটি উষ্ণ জায়গা, যেখানে নারীর স্বপ্ন ও পরিশ্রমের গল্প বলা হবে।’
# চীন, ডিজিটাল মুলান, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও নারী, শি জিনপিং, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক সাফল্য