সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এনইউএস) থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক মেগান লাউ এখন ম্যাকাওয়ের বিশ্বের বৃহত্তম ওয়াটার-শো হাউস অব ড্যান্সিং ওয়াটার-এ পারফর্ম করছেন একজন এরিয়ালিস্ট হিসেবে। সপ্তাহে ১০ থেকে ১২টি শোতে অংশ নেওয়া এই তরুণীই একমাত্র সিঙ্গাপুরীয়, যিনি ২০টি দেশের প্রায় ১০০ জন শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করছেন।
স্বপ্নের পথে প্রথম পদক্ষেপ
২০২৪ সালে ম্যাকাওয়ে পাড়ি দেওয়ার আগে মেগান গভীর অনিশ্চয়তায় ছিলেন—তিনি কি নিরাপদ ভবিষ্যতের বদলে স্বপ্নের পেছনে ছুটছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে অনলাইনে কাস্টিং বিজ্ঞাপন দেখে হঠাৎ করেই আবেদন করেন তিনি হাউস অব ড্যান্সিং ওয়াটার-এ। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি অডিশনের ডাক পান এবং পরে অভিনয়ের প্রস্তাবও আসে।
নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আমি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? আমার ডিগ্রিটা কি বৃথা যাবে?” কিন্তু শৈশব থেকে পাঁচ বছর বয়সে শুরু করা ব্যালে প্রশিক্ষণই তাঁকে এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত করেছিল বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়াটার শো
হাউস অব ড্যান্সিং ওয়াটার হলো ম্যাকাওয়ের একটি চমকপ্রদ থিয়েটার শো, যেখানে একত্র হয়েছে অ্যাক্রোবেটিকস, নৃত্য, স্টান্ট ও নাটক। শোটি একটি ৩০ ফুট গভীর পুলে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ৩.৭ মিলিয়ন গ্যালন পানি ব্যবহৃত হয়—যা পাঁচটি অলিম্পিক আকারের সুইমিং পুলের সমান।
২০১০ সালে প্রথম শুরু হওয়া এই শোটি প্রায় পাঁচ বছরের বিরতির পর ২০২৫ সালের মে মাসে পুনরায় মঞ্চস্থ হয়। এরপর থেকেই মেগান সপ্তাহে ১০ থেকে ১২টি পারফরম্যান্সে অংশ নিচ্ছেন। তিনি শোয়ের ‘প্রিন্সেস আনি’ চরিত্রের আন্ডারস্টাডি, মাসে এক-দু’বার এই ভূমিকায় অভিনয় করেন।
শৈশবের মঞ্চ থেকে আন্তর্জাতিক আকাশে
মেগানের নাচের প্রতি ভালোবাসা শুরু হয় খুব ছোটবেলায়। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার বাইরে প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটত ডান্স স্টুডিওতে। সময়ের সঙ্গে তিনি কনটেম্পোরারি, লিরিক্যাল ও জ্যাজ নৃত্যেও দক্ষতা অর্জন করেন এবং দেশ-বিদেশের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান।
২০২১ সালে সিঙ্গাপুরে একটি এরিয়াল আর্টস স্কুলে ভর্তি হয়ে শখের বসে ক্লাস শুরু করেন। দ্রুত দক্ষতা অর্জনের ফলে তিনি নিজেই আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
পরিবারে উদ্বেগ ও সমর্থন
তবে পেশাদার এরিয়ালিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্তে পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। মা সিনথিয়া সেং, যিনি নৃত্যশিল্পে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেন, বলেন—“এই কাজ শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, মেয়ে আমার ২০ মিটার উচ্চতায় ঝুলে কাজ করে।”
মেগানের ভাইও উদ্বিগ্ন ছিলেন—“তুমি কি সত্যিই এটা করতে চাও? দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে?”—তবে ধীরে ধীরে তাঁদের ভয় কমে যায়। মেগান তাঁদের প্রশিক্ষণের ভিডিও, নিরাপত্তা প্রোটোকল এবং ফিজিওথেরাপির নিয়মিত সেশনের তথ্য দেখিয়ে আশ্বস্ত করেন।
একা থাকার নতুন অভিজ্ঞতা
ম্যাকাওয়ে যাওয়ার পর তাঁকে একা থাকতে শিখতে হয়—বাড়ি খোঁজা, বিল দেওয়া, রান্না করা, নতুন শহরে পথ চিনে নেওয়া—সবই একসঙ্গে।
“কাজটা শারীরিকভাবে খুব চ্যালেঞ্জিং, তাই শরীর ও শক্তি ঠিকভাবে সামলানো জরুরি ছিল,” বলেন তিনি। প্রথমদিকে তিনি প্রতিদিন মাকে ফোন করতেন। মা তাঁকে বলতেন, “একদিন একদিন করে সামলাও এবং আনন্দ নাও।”
এখন তাঁর মা-ই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। প্রথম প্রিমিয়ারে মেয়েকে মঞ্চে দেখে গর্বে ভরে ওঠেন তিনি—“আমি পরদিন আবার শো দেখতে গিয়েছিলাম, কারণ আমার হৃদয় গর্বে পরিপূর্ণ ছিল।”
অপ্রচলিত পথে সাফল্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সেমিস্টারে ক্লাস ও রিহার্সালের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে মেগান সিঙ্গাপুর ও ম্যাকাওয়ের মধ্যে বারবার যাতায়াত করেন। ফ্লাইটে বসেই পড়াশোনা ও অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতেন তিনি।
যখন তাঁর সহপাঠীরা সরকারি বা বহুজাতিক কোম্পানিতে যোগ দেন, তখন মেগান বেছে নেন ভিন্ন পথ। তাঁর কথায়—“জীবন অনিশ্চিত। যা পড়েছি, তা মানে নয় যে জীবনের দিকও ঠিক সেভাবেই ঠিক করতে হবে। আমার পথটা হয়তো পরিকল্পিত ছিল না, কিন্তু এটি ভাগ্য ও সাহসের মিশ্রণ।”
আজ ম্যাকাওয়ের আকাশে ঝুলে নাচেন মেগান লাউ—একজন তরুণী, যিনি প্রমাণ করেছেন স্বপ্নে বিশ্বাস রাখলে জীবন বদলাতে পারে। তাঁর কথায়, “আমি প্রতিদিনই শিখছি, বেড়ে উঠছি এবং সবচেয়ে বড় কথা—আমি বেঁচে আছি, যা করছি তাতে।”
#ম্যাকাও, #হাউস_অব_ড্যান্সিং_#ওয়াটার, #এনইউএস,# মেগান_#লাউ, #এরিয়ালিস্ট, #আন্তর্জাতিক_নৃত্য, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট