করপোরেট আমেরিকার দুর্দমনীয় গতি
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলো যখন নতুন ত্রৈমাসিক ফলাফল প্রকাশ করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট মেশিন যেন গর্জন করছে—‘পথ ছাড়ো!’ বিশ্লেষকেরা বলছেন, টানা নবম ত্রৈমাসিকে বড় প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য ও অভিবাসন নীতিতে অর্থনীতির ক্ষতি হবে বলে যারা বাজি ধরেছিল, তারা এখন নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত। ২০২৫ সালে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের মান বেড়েছে ১৪ %, যা ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের নতুন শেয়ারমূল্য সৃষ্টি করেছে।
কেবল এআই নয়, উচ্ছ্বাস পুরো অর্থনীতিতেই
যদিও এআই-নির্ভর ১০টি বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি—এনভিডিয়া, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট, অ্যামাজন, মেটা, ব্রডকম, টেসলা, ওরাকল ও প্যালান্টিয়ার—সূচকের মোট প্রবৃদ্ধির তিন-পঞ্চমাংশে ভূমিকা রেখেছে, বাকি ৪৯০টি প্রতিষ্ঠানও মোট ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্য বৃদ্ধি করেছে।
২০ অক্টোবর, কোকা-কোলা, থ্রিএম ও জেনারেল মোটরস প্রত্যাশার চেয়ে ভালো আয় প্রকাশ করায় তাদের শেয়ারমূল্য যথাক্রমে ৪ %, ৮ % ও ১৫ % বেড়েছে। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীদের উচ্ছ্বাসের জন্য শুধু এআই নয়—সোডা, পোস্ট-ইট আর পিকআপ ট্রাকও যথেষ্ট।
এই উত্থানকে ত্বরান্বিত করছে ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার হ্রাস এবং ট্রাম্পের ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা—যেমন করছাড় অব্যাহত রাখা, আর্থিক ও জ্বালানি খাতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা, এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কর্পোরেট চুক্তিতে সরকারি হস্তক্ষেপ না করা।

নন-এআই খাতে বিপদের ইঙ্গিত
তবে এআই-এর বাইরে অর্থনীতির ইঞ্জিনের নিচে কিছু অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাতা ফার্স্ট ব্র্যান্ডস, ও ঋণদাতা ট্রাইকোলারের পতন বাজারে ঋণ সংকটের প্রাথমিক ইঙ্গিত দিয়েছে।
যদিও কোকা-কোলার ফল ভালো, খাদ্য ও দৈনন্দিন পণ্যের বড় কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্স ১৯৮৮ সালের পর সবচেয়ে দুর্বল দ্বিতীয় সময় পার করছে। জেনারেল মোটরসের শেয়ারমূল্য বাড়লেও তাদের তৃতীয় ত্রৈমাসিক মুনাফা গত বছরের তুলনায় ১৮ % কমেছে—তবুও প্রত্যাশার তুলনায় ক্ষতি কম হওয়ায় বাজারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে তাদের বার্ষিক নিট মুনাফা অন্তত ২.৩ বিলিয়ন ডলার কমবে। ফোর্ডও একই আঘাতের আশঙ্কা করছে।
ট্রাম্পের নীতির অনিশ্চয়তা ও ব্যবসায়িক দ্বিধা
বড় সমস্যা করের পরিমাণ নয়, বরং তার অনিশ্চয়তা। ট্রাম্প কি সত্যিই চীনের ওপর ১০০ % শুল্ক বসাবেন? ইন্টেলের মতো অন্যান্য কোম্পানিও কি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ঝুঁকিতে পড়বে?
বর্তমানে আয় তেমন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও এই অনিশ্চয়তা ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, এই অবস্থায় নন-এআই কোম্পানিগুলো নতুন বিনিয়োগে যেন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।

বিনিয়োগের চিত্র: সংখ্যা বাড়লেও ভারসাম্যহীনতা স্পষ্ট
২০২৫ সালে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের কোম্পানিগুলো সম্মিলিতভাবে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি মূলধনী ব্যয় (ক্যাপেক্স) করতে চলেছে। প্রথম ছয় মাসে ৪০৫টি কোম্পানি মিলে ব্যয় করেছে ৫৫৪ বিলিয়ন ডলার—গত বছরের তুলনায় ২১ % বেশি।
তবে এই বৃদ্ধির চিত্র বিভ্রান্তিকর। যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যয় বাড়িয়েছে, তারা মিলিতভাবে ১২৩ বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ করেছে—এক বছরে ৪২ % বৃদ্ধি। কিন্তু প্রায় অর্ধেক কোম্পানি, ১৮৬টি—তাদের ব্যয় কমিয়েছে ২৭.৬ বিলিয়ন ডলার, এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশি আগামী অর্থবছরে আরও কাটছাঁটের পরিকল্পনা করছে।
এই ব্যয় হ্রাসকারীদের মধ্যে রয়েছে কার্নিভাল ও রয়্যাল ক্যারিবিয়ান (৩.১ বিলিয়ন ডলার কম), জিএম, টেসলা ও ফোর্ড (২.৯ বিলিয়ন), ফাইজার (৭৭৭ মিলিয়ন), এবং শেভরন (৪১৬ মিলিয়ন)। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মিলিতভাবে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের মোট মূলধনী ব্যয়ের ২৪ %, বাজারমূল্যের ২৬ %, আয়ের ৩৫ % এবং কর্মীবলের ৩৭ % ধারণ করে।
আমদানি-নির্ভর খাতে বিনিয়োগে সংকোচন
যেসব খাত ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের নীতিতে সরাসরি প্রভাবিত—যেমন গাড়ি, খাদ্য ও পানীয়, পুঁজি সরঞ্জাম, ভোক্তা সেবা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তারা বিনিয়োগ কমাচ্ছে। গাড়ি শিল্পের ব্যয় প্রথম ছয় মাসে ২০ % কমেছে, খাদ্য ও পানীয় শিল্পে ১৫ %, এবং ভোক্তা সেবা খাতে ১৪ %।

ট্রাম্পের নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি অনাগ্রহের কারণে AES ও নেক্সটএরা’র মতো কোম্পানিও বিনিয়োগ কমিয়েছে।
এআই-এর ওপর নির্ভর বিনিয়োগ প্রবাহ
মূলধনী ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ এসেছে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের এআই-কেন্দ্রিক বিনিয়োগ থেকে। অ্যালফাবেট, অ্যামাজন, মেটা, মাইক্রোসফট ও ওরাকল—এই পাঁচটি কোম্পানি একাই অতিরিক্ত ৭৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ডেটা সেন্টার নির্মাণে। এমনকি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিরিক্ত ৯ বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ের প্রধান কারণও এই ডেটা সেন্টারগুলোর বিদ্যুৎ চাহিদা।
ভবিষ্যৎ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নাকি কৃত্রিম আত্মতুষ্টি?
যদি এই এআই-ভিত্তিক বিনিয়োগ সফল হয়, তবে নন-এআই খাতও তার সুফল পেতে পারে—তাদের হয়তো নিজস্ব পুঁজিনিবেশ ছাড়াই মুনাফা বাড়বে। তবে আপাতত তারা অপেক্ষায়—ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ও নীতিগত দিকনির্দেশনা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত।
কিন্তু যত দীর্ঘ এই অপেক্ষা, ততই ঝুঁকি বাড়ছে—কর্পোরেট আমেরিকার মুনাফার ইঞ্জিন হয়তো ধীরে ধীরে থেমে যেতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















