কোরিয়ান শেয়ারবাজারে নজিরবিহীন উত্থান
২০২৫ সাল বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারের জন্য সফল বছর হলেও, দক্ষিণ কোরিয়ার বাজার ছিল ব্যতিক্রমী। দেশটির প্রধান সূচক কসপি-২০০ (KOSPI 200) এ বছর উনচল্লিশ শতাংশ নয়, বরং ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা আমেরিকার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের ১৫ শতাংশ বৃদ্ধিকেও ছাপিয়ে গেছে।
এই উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনা, বিশেষ করে স্যামসাং ইলেকট্রনিকস ও এসকে হাইনিক্সের মতো চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য। তবে এর বাইরেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে—রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত “ভ্যালু-আপ” কর্মসূচি, যার লক্ষ্য করপোরেট গভর্ন্যান্স বা কোম্পানি পরিচালনার মানোন্নয়ন এবং তথাকথিত “কোরিয়া ডিসকাউন্ট” দূর করা।
সংস্কারের মূল ধারা: শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষমতায়ন
২০২৪ সালের শুরুতে শুরু হওয়া ‘ভ্যালু-আপ’ উদ্যোগটি সম্প্রতি নতুন গতি পেয়েছে। জুনে লি জে-মিয়ং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সংসদ দুই দফা বাণিজ্য আইন (Commercial Act) সংশোধন করেছে, যা সরকারি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনছে।
এখন থেকে ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতি নয়, শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিও দায়বদ্ধ থাকবেন—যা আগে ছিল না। এই নতুন আইনে সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে এবং প্রভাবশালী করপোরেট পরিবারগুলোর কর্তৃত্ব কমানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং শেয়ারহোল্ডার মিটিংয়ের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা হয়েছে।

বছর শেষের আগে আরেক দফা সংস্কার প্রত্যাশিত। এবার লক্ষ্য ‘ট্রেজারি শেয়ার’ বাতিল করা, যেগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের মূল্য কমিয়ে দেয় এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়।
করপোরেট আচরণে পরিবর্তন ও শেয়ারমূল্যের উল্লম্ফন
এই পরিবর্তনের প্রভাবে শত শত প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই তাদের ট্রেজারি শেয়ার বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৩ সালের পর থেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুনঃক্রয়ের হার দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
একসময় সমালোচনায় কর্ণপাত না করা প্রতিষ্ঠান ইনফোভাইন—যারা বছরের পর বছর নগণ্য লভ্যাংশ দিত এবং ট্রেজারি শেয়ার ধরে রাখত—তাদের ওপর ২০২৪ সালের কর্মী ও বিনিয়োগকারী আন্দোলন কার্যকর হয়েছে। কোম্পানিটি এখন শেয়ার পুনঃক্রয় করেছে এবং লভ্যাংশ এক-তৃতীয়াংশ বাড়িয়েছে। ফলে, ২০২৫ সালে তাদের শেয়ারমূল্য তিনগুণ বেড়েছে।
একইভাবে, কেবি ফাইন্যান্সিয়াল, দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংক গোষ্ঠীর মালিক প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারীদের আহ্বানে বিদেশি অধিগ্রহণ কমিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে মুনাফা ফেরত দিচ্ছে। বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান অরবিসের বেন প্রেস্টন জানিয়েছেন, এই নীতির ফলে কেবি ফাইন্যান্সিয়ালের শেয়ারের মূল্য ২০২৪ সালের শুরু থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।

অসম্পূর্ণ বিপ্লব: করপোরেট পরিবারের আধিপত্য এখনো অটুট
তবে এই সংস্কার প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়ার বড় বড় করপোরেট গ্রুপ বা ‘চেবোল’ এখনো জটিল মালিকানা কাঠামো বজায় রেখেছে, যা পরিবারগুলোর প্রভাবকে শক্তিশালী করে রাখে।
স্যামসাং সি অ্যান্ড টি, দেশটির বৃহত্তম কনগ্লোমারেটের নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানি, ২০২৪ সালে শেয়ারহোল্ডারদের প্রস্তাবিত লভ্যাংশ বৃদ্ধির দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ, কোম্পানির দুই-পঞ্চমাংশ শেয়ারই রয়েছে স্যামসাং চেয়ারম্যানের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে।
জাপানে যেখানে কোম্পানিগুলো একে অপরের শেয়ার বিক্রি করে পারস্পরিক মালিকানা কমাচ্ছে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় এ ধরনের অগ্রগতি এখনো খুব ধীর।
কোরিয়া ডিসকাউন্ট এখনো রয়ে গেছে
সব ইতিবাচক পরিবর্তন সত্ত্বেও, তথাকথিত “কোরিয়া ডিসকাউন্ট” এখনো দূর হয়নি। কসপি-২০০ সূচকের অর্ধেকের বেশি কোম্পানির শেয়ার এখনো তাদের প্রকৃত সম্পদের বইমূল্যের নিচে লেনদেন হচ্ছে। তুলনায়, জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচকে এই হার মাত্র ৩১% এবং আমেরিকার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে ৪%।

এছাড়া, বাজার এখনো প্রেসিডেন্ট লির ঘোষিত ‘কসপি ৫০০০’ লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ২৫% নিচে অবস্থান করছে।
ভবিষ্যতের প্রশ্ন: লি জে-মিয়ং কতদূর এগোবেন?
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারে এখন গভর্ন্যান্স সংস্কারের এক সন্ধিক্ষণ চলছে। প্রশ্ন হলো—প্রেসিডেন্ট লি কি দেশের প্রভাবশালী করপোরেট পরিবারগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাবেন, নাকি এখনকার অগ্রগতিতেই সন্তুষ্ট থাকবেন?
যা-ই হোক, “ভ্যালু-আপ” কর্মসূচি ইতিমধ্যেই এক নতুন করপোরেট যুগের সূচনা করেছে—যেখানে শেয়ারহোল্ডার, স্বচ্ছতা, ও দায়বদ্ধতা দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়িক সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।
# দক্ষিণ_কোরিয়া, কসপি, করপোরেট_গভর্ন্যান্স, ভ্যালু_আপ, লি_জে_মিয়ং, স্যামসাং, কেবি_ফাইন্যান্সিয়াল, ইনফোভাইন, ইকোনমিস্ট_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















