প্রাচীন ধ্যানধারণা থেকে আধুনিক যুদ্ধব্যবসা
নিখোলো ম্যাকিয়াভেলি একসময় ভাড়াটে সৈন্যদের বলেছিলেন “অবিশ্বস্ত ও বিপজ্জনক”—যারা কেবল অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ করে, কিন্তু জীবন দিতে রাজি নয়। অথচ আজ, পাঁচশ বছর পর, আধুনিক ‘প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি’ (PMCগুলো) বিশ্বজুড়ে বিপুল গতিতে প্রসারিত হচ্ছে।
সংঘাতের ছায়ায় বাণিজ্যের প্রসার
যুদ্ধ যেমন ধ্বংস আনে, তেমনি ব্যবসার সুযোগও সৃষ্টি করে। এ বছরের শুরুতে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে নিয়োজিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (GHF) নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ‘ইউজি সলিউশনস’ নিয়োগ দেয়। রাশিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ ও আফ্রিকার অভিযানে তার ‘ওয়াগনার গ্রুপ’-এর উপর নির্ভর করে—যা মূলত প্রাক্তন রুশ বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত।
ইউক্রেনে এখন লাতিন আমেরিকার, বিশেষ করে কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনারাও যুদ্ধ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মতো সংস্থাগুলিই এসব কোম্পানির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। প্রাক্তন সেনা সদস্য—বিশেষত স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের—নিয়ে গঠিত এই শিল্প এখন বিশাল পরিসরে বিস্তৃত।
![Dólar à vista [chevron_left]brby[chevron_right] sobe 0,15%, a r$5,3993 na venda, nos primeiros negócios do dia | Reuters](https://www.reuters.com/resizer/v2/MHG23WQZTBOMNJQEQ63C3U42BA.jpg?auth=86d70463298b5736467ad6032cfa684ac4213d9ea1849272359f455e3ce2ce96&width=5500&quality=80)
ইরাক থেকে ইউক্রেন: নতুন ‘বুম’-এর আশা
২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইরাকে PMC ব্যবসা ছিল তুঙ্গে। প্রাক্তন ব্রিটিশ অফিসার টিম স্পাইসারের নেতৃত্বে ‘এজিস’ ও ‘স্যান্ডলাইন ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতো কোম্পানি সেখানে হাজার হাজার ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছিল। বর্তমানে এই খাতে আধা ডজন বড় কোম্পানি রয়েছে—যাদের রয়েছে নিজস্ব আইন, মানবসম্পদ ও চুক্তি বিভাগ।
তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কনস্টেলিস’ (২০২৪ সালে রাজস্ব ১.৪ বিলিয়ন ডলার, কর্মী ১২,৭০০ এর বেশি) এবং কানাডার ‘গার্ডাওয়ার্ল্ড’ বহু দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাজারে বড় পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি রয়েছে অনেক ছোট কোম্পানি, যারা বড় চুক্তির সুযোগ পেলেই সক্রিয় হয়।
তিন ভাষার ‘সামরিক সংস্কৃতি’
ওয়াশিংটন ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির শন ম্যাকফেইট, যিনি একসময় আফ্রিকায় মার্কিন স্বার্থে ছোট বাহিনী গঠন করেছিলেন, বলেন—PMC দুনিয়া তিনটি ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত:
১. ইংরেজিভাষী—আমেরিকা ও ইউরোপের কোম্পানিগুলো
২. রুশভাষী—মস্কোভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো
৩. স্প্যানিশভাষী—লাতিন আমেরিকার, বিশেষ করে কলম্বিয়ার প্রাক্তন বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা, যারা মার্কিন ‘গ্রিন বেরেট’ বাহিনীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।

সস্তা বিকল্প, আকর্ষণীয় আয়ের উৎস
সরকারগুলো যেখানে নতুন সৈন্য নিয়োগে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে PMCগুলো তুলনামূলকভাবে সস্তা সমাধান দিচ্ছে। স্পাইসারের হিসাবে, এক মার্কিন ঠিকাদার নিয়মিত সৈন্যের চেয়ে সাতগুণ সস্তা, আর একজন ব্রিটিশ ভাড়াটে সৈন্য প্রায় দশগুণ সস্তা।
অন্যদিকে, কলম্বিয়ান ভাড়াটেরা নিজের দেশের সেনাদের তুলনায় অনেক বেশি আয় করে এবং উন্নত পরিবেশে থাকে। রুশ ভাড়াটেরাও ইউক্রেন যুদ্ধে সাধারণ সৈন্যদের দ্বিগুণ বেতন পেয়েছে। তবে অনেকেই শুধু অর্থ নয়, স্বাধীনতার আকর্ষণেও এই পেশায় আসে—কারণ তারা নিজেদের ইচ্ছায় মিশনে অংশ নিতে বা না নিতে পারে।
যুদ্ধক্ষেত্রের ‘কমব্যাট সলিউশন’
যদিও অধিকাংশ PMC সরাসরি যুদ্ধ করে না, গত এক দশকে অনেকেই “কমব্যাট সলিউশন” সেবা দিতে শুরু করেছে। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উলরিখ পিটারসনের হিসেবে, একসময় ইউক্রেনে ৫০,০০০ এরও বেশি বেসরকারি যোদ্ধা সক্রিয় ছিল, বিশেষত রুশপক্ষের হয়ে।
বিতর্ক ও নৈতিক প্রশ্ন
ওয়াগনারের মতো গোষ্ঠী যুদ্ধক্ষেত্রে PMC ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মনে করেন স্পাইসার। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০-২০১৬ সালে ভাড়াটে বাহিনীর উপস্থিতি বেসামরিক হতাহতের হার ৩৯% কমিয়েছে—বিশেষত গণতান্ত্রিক দেশভিত্তিক কোম্পানির ক্ষেত্রে এই হার ৬৬% পর্যন্ত কম।

তবুও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকেও নানা বিতর্কে জড়াতে হয়েছে। গাজায় GHF নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক ‘অ্যান্টি ইসলাম’ বাইকার গ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যবহার করেছিল, যা পরে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। আবার কুখ্যাত এরিক প্রিন্সের প্রতিষ্ঠিত ‘ফ্রন্টিয়ার সার্ভিসেস গ্রুপ’ ২০২৩ সালে চীনা পাইলট প্রশিক্ষণ দেওয়ায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে।
ইউক্রেন-পরবর্তী সময়: সম্ভাব্য উত্থান
বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় PMC খাত আবার বড় উত্থান দেখতে পারে। যুদ্ধশেষে প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ পাওয়া, হাজারো সৈন্য নতুন চুক্তিতে যুক্ত হতে প্রস্তুত থাকবে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের নিজস্ব PMC গঠনের কথা বলেছেন।
মার্কিন সেনারাও ২০২১ সালের কাবুল পতনের পর বিশ্রাম শেষে নতুন অভিযানে অংশ নিতে প্রস্তুত। তাদের অনেককে লাতিন আমেরিকার মাদকবিরোধী অভিযানে বা খনিজ সম্পদ রক্ষায় ব্যবহার করা হতে পারে।
যুদ্ধের বেসরকারিকরণ
শন ম্যাকফেইটের মতে, “যুদ্ধ এখন বেসরকারিকরণের পথে দ্রুত এগোচ্ছে। যারা বিষয়টি বুঝছে—যেমন রাশিয়া—তারা সুবিধা নিচ্ছে; আর যারা বুঝছে না, যেমন পশ্চিমা দেশগুলো, তাদের জন্য তা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।”
#সংঘাত #যুদ্ধ #প্রাইভেট_সেনা #ইউক্রেন #PMC #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















