দক্ষিণ কোরিয়ায় শুরু এপেকের বড় আসর
দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর গ্যংজুতে এ বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (এপেক) সম্মেলন। আয়োজক হিসেবে প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ংয়ের জন্য এটি এক বড় কূটনৈতিক পরীক্ষা, যেখানে উপস্থিত রয়েছেন তিন মহাশক্তির শীর্ষ নেতা—চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সম্মেলনের মূল অধিবেশন শুরু হবে শুক্রবার, তবে সবচেয়ে আলোচিত মুহূর্ত হতে পারে তার আগেই—বৃহস্পতিবার সম্ভাব্য ট্রাম্প–শি বৈঠক।
যুক্তরাষ্ট্র–চীন বৈঠক: বরফ গলবে কি?
গত সপ্তাহে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে দুই দেশের আলোচকরা একটি প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করেছেন, যা এই বৈঠকে চূড়ান্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সচিব স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, এটি “একটি কাঠামোগত ঐকমত্য”; অন্যদিকে চীন একে বলছে “প্রাথমিক সমঝোতা”।
এটি হবে ট্রাম্প ও শির প্রথম মুখোমুখি বৈঠক ২০১৯ সালের জুনের পর। উভয়ের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক, প্রযুক্তি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, এবং শিপিং খরচ নিয়ে উত্তেজনা চলমান। আলোচনায় টিকটক, রেয়ার আর্থ খনিজ এবং কৃষিপণ্য ক্রয়সহ নানা বিষয় উঠে আসতে পারে।

বিশ্ববাজারে আশাবাদ থাকলেও বিশ্লেষকেরা সতর্ক। সাংহাই ইন্সটিটিউটস অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের শাও ইউকুন বলেছেন, “এই বৈঠক থেকে বড় কোনো অগ্রগতি আশা করা ঠিক হবে না। কাঠামোগত সমস্যার কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও তীব্র হতে পারে।”
ম্যাককুয়ারি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, যদি সাময়িকভাবে সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হয়ও, তা হবে আগের মতোই “উত্তেজনা–শান্তি–আবার উত্তেজনা” ধাঁচের পুনরাবৃত্তি।
ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের উ সিনবো বলেছেন, “এই বৈঠকে উভয় পক্ষ মালয়েশিয়ার আলোচনার সারাংশই পুনর্ব্যক্ত করবে। তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে ভবিষ্যতে সম্পর্ক কীভাবে পরিচালিত হবে, সে দিকেও বার্তা দেওয়া হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “চীন এখন প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে, তাই দুই দেশের খেলাটা আর এক নয়—যুক্তরাষ্ট্র পুরনো কৌশল চালাচ্ছে, চীন নতুন খেলা খেলছে।”
চীনের ‘স্বনির্ভরতার’ সংকল্প
শি জিনপিংয়ের নামে প্রকাশিত এক নীতিপত্রে বলা হয়েছে, চীনকে “প্রবল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে কৌশলগত অগ্রাধিকার অর্জন করতে হবে।” কমিউনিস্ট পার্টির সাম্প্রতিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোচনায় শি জোর দিয়েছেন প্রযুক্তি, শিল্প ও আধুনিকায়নে স্বনির্ভরতার ওপর।
প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক ড্যানিয়েল ক্রিটেনব্রিঙ্ক মন্তব্য করেছেন, “বেইজিং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে শিখেছে যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালে সম্মান পাওয়া যায়। তাই এখন যেকোনো চুক্তি কৌশলগত পরিবর্তন নয়, বরং সাময়িক স্থিতিশীলতা আনবে।”
চীনের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার ভারসাম্যের চেষ্টা
২০১৪ সালের পর এই প্রথম চীনে সফরে যাচ্ছেন শি জিনপিং, আর প্রেসিডেন্ট লি-এর জন্য এটি এক কঠিন কূটনৈতিক ভারসাম্যের সময়। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা অংশীদার এবং চীনের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার—দুইয়ের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে সিউল।

সম্প্রতি চীন দক্ষিণ কোরিয়ার শিপবিল্ডার হানহা ওশানের পাঁচটি মার্কিন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, অভিযোগ—তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্পখাতে চাপ বেড়েছে।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনবিরোধী মনোভাবও বাড়ছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, নাগরিকদের বড় অংশ এখন চীনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। প্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পের উদ্যোক্তারাও আশঙ্কা করছেন, চীনা প্রতিযোগীরা ক্রমে তাদের বাজার দখল করছে।
বিশ্লেষক লি হি-ওক লিখেছেন, “এপেকে সিউল–বেইজিং সম্পর্কের বড় কোনো অগ্রগতি আশা করা যাচ্ছে না, কারণ উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই নিজেদের কৌশল সাজাচ্ছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি: লির নতুন পরীক্ষা
এপেক আয়োজনের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর চাপ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক–বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার। গত জুলাইয়ে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে লি ও ট্রাম্প এক প্রস্তাবনায় সম্মত হয়েছিলেন—যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামাবে, এর বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
তবে সেই চুক্তি এখনও স্বাক্ষরিত হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়া আশঙ্কা করছে, এত বড় বিনিয়োগে তাদের মুদ্রা ‘উন’-এর মান ভয়াবহভাবে পড়ে যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট লি বলছেন, চুক্তি “এখনও দূরের বিষয়,” আর ট্রাম্প দাবি করছেন, “প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে।”
অর্থনীতিবিদ শিন সে-দন মন্তব্য করেছেন, “লি স্পষ্ট করেছেন—৩৫০ বিলিয়ন ডলার তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না। হয়তো ২০০ থেকে ২৫০ বিলিয়নের মধ্যে নামানোর চেষ্টা করবেন।”
তাকাইচির কূটনীতি: জাপানের নতুন ভারসাম্য
নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী। অতীতে কঠোর বক্তব্য দেওয়া সত্ত্বেও লি ও তাকাইচির মধ্যে উষ্ণ সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে পূর্বসূরি ইশিবার সঙ্গে লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায়।
তাকাইচি সাম্প্রতিক নীতিবক্তৃতায় বলেছেন, তিনি দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে “মিনিল্যাটারাল” নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চান। একই সঙ্গে তিনি চীন, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সামরিক কর্মকাণ্ডকে “গুরুতর উদ্বেগের বিষয়” বলে উল্লেখ করেছেন, যা বেইজিংয়ের প্রতিবাদ ডেকে এনেছে।

তিনি বলেছেন, “চীনের সঙ্গে খোলামেলা সংলাপই সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে পারে।” এখন দেখা যাক, শি জিনপিং এই প্রস্তাবে সাড়া দেন কি না।
ট্রাম্প–কিমের পুনর্মিলন কি সম্ভব?
এপেকে আরেকটি সম্ভাব্য চমক হতে পারে ট্রাম্প–কিম জং উনের পুনর্মিলন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দু’বারের শীর্ষ বৈঠক এবং সীমান্তে আকস্মিক সাক্ষাতের পর ট্রাম্প আবারও এমন বৈঠকের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। উত্তর কোরিয়া এখন চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিশ্লেষক চি হিউং হ্যারিসন কিমের মতে, “কিম আগের অভিজ্ঞতায় হতাশ—এখন তিনি বিশ্বাস করেন না যে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনায় কিছু পাওয়া সম্ভব।”
#APEC2025,# দক্ষিণ_কোরিয়া,# ট্রাম্প,# শি_জিনপিং,# তাকাইচি,# লি_জে_মিয়ং, #যুক্তরাষ্ট্র_চীন_সম্পর্ক,# কূটনীতি, #এশিয়া_রাজনীতি, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















