সভ্যতায় প্রবেশের দিন
১৭ অক্টোবর থেকে আমরা ঘোষিতভাবে বর্বরতা থেকে সভ্যতার জগতে এলাম। আর এই সভ্যতার জগতে প্রবেশের চাবিটি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে জুলাই সনদ। অর্থাৎ ২০২৪-এর জুলাই মাসে মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে, মেথডিকালি যেভাবে সরকার পতন ঘটানো হয়েছে— সেই কাজকে ভিত্তি করে যে জুলাই সনদ তৈরি হয়েছে, তাতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল সই করেছে, যার ভেতর বিএনপি ছাড়া আর কারো সারাদেশে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
যাহোক, ঘটনা যাই হোক, আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতার জগতে প্রবেশ করেছি। এবং সেটা বিশ্ববাসী দেখেছে।
ভারতের প্রসঙ্গ ও বাঙালির আত্মসমালোচনা
বিশ্ববাসীর মধ্যে আমাদের এই উপমহাদেশের ভারতের নাম বলা যাবে না। তাদের পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সভ্যতা থাকলেও তাদের কথা বললেই গোলমাল আছে। ওই দেশের আর্যভট্ট থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী অবধি কারো নাম বলা যাবে না। (তবে আদানির নাম মনে হয় বলা যাবে)।
যাক, আমাদের প্রধান উপদেষ্টার রোমে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে শব্দ ধার নিয়ে বলা যায়, “বাঙালিরা যেখানে যায় সেখানেই ভেজাল সৃষ্টি করে।” তাই আমি আবার কোনো কথায় ভেজাল সৃষ্টি না করে ফেলি। তবে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষ নিয়ে কারো কিছু যায় আসে না।
তাছাড়া আমার পূর্বপুরুষ কংগ্রেস ও ফরোয়ার্ড ব্লকের মানুষ হলেও আমি কখনও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ওইভাবে ভাবতেও পারি না। একজন শাদা চামড়ার মানুষ যখন আমার জুতো পালিশ করে তখন আমি অনেক বেশি আনন্দিত হই। বরং আমি চুপি সারে বলি, শাদা চামড়া দেখলেই আমার প্রণিপাত করতে ইচ্ছে করে। আহা, তাহারা যদি কিছু কৃপা করে— ধনে অথবা মানে।
চীনের সভ্যতা ও অতীশ দীপঙ্কর
তাই শাদারা যাদেরকে গোলাপি বলে ঠাট্টা করে সেই চায়নার কথা বলা যাক। চায়নারও পাঁচ থেকে সাত হাজার বছরের সভ্যতার যুগ আছে। চায়নার এই সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে তাদের যেমন কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে লীসহ শত মনীষীর ছোঁয়া আছে, তেমনি এই সভ্যতার আলো তিব্বত হয়েও পৌঁছেছিল।
আর সে আলোতে যোগ করেছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর জন্ম আজকের বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। তাঁর জন্মকালে ও দেশে ও বিদেশে জ্ঞান বিতরণের কালে যেহেতু জুলাই সনদ ঘোষণা হয়নি— এখন বর্বরদের তালিকা করতে গেলে তাকেও সেই তালিকায় রাখতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের রেহাই
রবীন্দ্রনাথ বেঁচে গেছেন। তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ একবারের জন্যে মাত্র বজরা নিয়ে তাদের বাগেরহাটের কুশারী বাড়ির দীঘি পাড়ে এসেছিলেন। বাড়িতে ওঠেননি। তাই বাপ-ব্যাটা দুজনেই বেঁচে গেছেন— বর্বরতার খাতায় নাম লেখা যাবে না তাদের। কারণ দুজনেই ভিন্ন দেশের মানুষ।
কোনো দুষ্টলোক বলতে পারে, এর পরেও রবীন্দ্রনাথ পার পাবেন না— বেচারার শ্বশুরবাড়ি এই বাংলায়। না, ওই পথ আমরা আটকে রেখেছি। আমরা সভ্যরা আমাদের একটি শ্বশুরবাড়ি রবীন্দ্রনাথের দেশেই রেখে দিয়েছি। অর্থাৎ সভ্যতার সঙ্গে শ্বশুর নিয়ে টানাটানি করা যাবে না। তবে তারপরেও রবীন্দ্রনাথ কিছুটা বিপাকে পড়তে পারেন, কারণ বেচারার শ্বশুরবাড়ি একটাই।
তবে বাঙালির সৌভাগ্যই বলতে হবে, যদিও নজরুল ইসলামের কবরটি এখানে জোর করে দেওয়া হয়েছিল— তারপরেও তাঁর বাড়ি বর্ধমানে। এখনও তাদের ঘরবাড়ি সেখানেই আছে। তাই ১৭ অক্টোবর বা জুলাই সনদ হিসেব করে আর যাই হোক, তাঁকে বর্বরতার খাতায় নাম ওঠানো যাবে না। তিনি এই সভ্যতার জগতে প্রবেশ করা থেকেও রেহাই পাবেন।
বিজ্ঞানীরা ও বর্বরতার তালিকা
বিজ্ঞানী জগদীশ বসুর বাড়িটি এখনও বিক্রমপুরে। তিনি কলকাতায় বাস করলেও কখনও বিক্রমপুরের বাড়ির সঙ্গে যোগসূত্র ত্যাগ করেননি। তাই তাঁকে যদি কেউ বর্বরের খাতায় বসিয়ে দেয় তার কিন্তু কিছুই করার নেই। কারণ সোজা তাঁকে সনদ দেখানো হবে।
আর সনদ অনুযায়ীই তো পৃথিবীতে সবকিছু হিসেবনিকেশ হয়। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা দেশত্যাগ করেছিলেন, কবি বুদ্ধদেব বসু থেকে জীবনানন্দ দাশ, তারাপদ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় সকলে দেশ ত্যাগ করেছিলেন— তাই মেরে কেটে তাঁদের বংশধররা তাঁদেরকে কোনো মতে বর্বরতার তালিকা থেকে বাদ রাখতে পারবেন বলে ভরসা করা যায়।
তবে যেহেতু আমাদের মাঠটি ওয়ার্ল্ড কাপের, পায়েও ওয়ার্ল্ড কাপের কেডস বা বুট, তাই দেশ ছাড়লেও তাঁদের আত্মা বর্বরতার খাতা থেকে রেহাই পাবেন কিনা বলা শক্ত।
সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও তাঁর বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে, তিনি রেহাই পেয়ে গেলেন। তবে জামাল নজরুল ইসলামের রেহাই পাওয়ার কোনো পথ নেই।
রাজনীতি ও শিক্ষা
ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে একটা আইনি লড়াই করা যায়। কারণ, তাঁর একটি বিষয় ছিল সংস্কৃত। আবার তিনি দেশভাগ না হলে আসতেন না। যেহেতু আইনত জটিলতায় তাঁকে আসতে হয়েছে— তাই এই আইনি লড়াইটি চলতে পারে।
এখন একজন রাজনীতিবিদের নাম প্রথমে বলতে হয়— শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি যুক্তবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আবার এই পূর্ববাংলারও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। অতএব তাঁকে বর্বরতার খাতায় উঠতেই হবে।
এমনকি তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষককেও রক্ষা করতে পারবেন না। তাঁর প্রিয় শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (পি. সি. রায়)— আধুনিক ভারতের ও বাঙালি বিজ্ঞানীদের জনক।
তেমনি তাঁর প্রিয় ছাত্র রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা ফজলুল হকসহ আরও অনেকে। তাঁর বাড়ি এই পূর্ববাংলার খুলনার রাডুলি গ্রামে।
অতএব জাতিকে রক্ষা করার জন্যে, জাতিকে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্যে, জাতিকে শাদা চামড়ার থেকে তার ঐতিহ্য বড় এসত্য জানানোর জন্যে- সিন্ধুদের কূল বেয়ে আসা এই মানুষেরা যে হাজার হাজার বছর ধরে রসায়নচর্চা করেছেন, অবদান রেখেছেন রসায়ন বিদ্যায়— তা শাদা চামড়ার কারণে ঘুমিয়ে পড়া একটা জাতিকে জানাবার জন্যেই “হিস্টরি অফ হিন্দু কেমেস্ট্রি” লিখেছিলেন।
আর বিজ্ঞানে তাঁর মৌলিক আবিষ্কার, মেঘনাদ সাহার আবিষ্কার, জগদীশ বসুর আবিষ্কার— সবই নোবেলকে পেছনে ফেলে আরও যুগান্তকারী। যাহোক, এই ১৭ অক্টোবরের পরে তাঁদের অবস্থান বদলে গেল। তাঁরা বর্বর যুগেরই মানুষ।
বর্বরতার সনদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
আর বিপিন পাল, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের সূর্যসন্তানরা সকলে শাদা চামড়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আর সকলের শুরু ও শেষ ১৭ অক্টোবরের আগে। অতএব কারো রেহাই নেই। আমাদের হাতে সনদ আছে। অতএব সনদ অনুযায়ী সকলেই বর্বর যুগের মানুষ।
যাহোক, এভাবে ইতিহাস তুলে ধরা কোনো সাংবাদিকের কাজ নয়— এটা ঐতিহাসিকদের বিষয়। তবে যেমন জানা যায়, জাস্টিস মোরশেদের জন্ম ছয় শত বছরের এলিট একটি পরিবারে। এখন ১৭ অক্টোবরের পরে এই মানুষটিকে কোথায় রাখবেন? তাঁদের নিয়ে হিসেব করতেও তো লজ্জা করে।
আর ১৯৪৬–৪৭ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে বাঙালি মুসলিম তরুণদের আরেকটি রেনেসাঁ শুরু হয়— যাদের প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ, সাহস বিশ্ববুকে ইতিহাস রচনা করেছিল— সেই শিক্ষক–ছাত্রদের ১৭ অক্টোবরের পরে সনদ অনুযায়ী কোথায় রাখা হবে?
শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, তখন কেবলই ছাত্র থেকে বের হয়ে গেছেন কমরুদ্দীন আহমদ, তখনও ছাত্র; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কমরেড তোয়াহা, অলি আহাদ— এমনকি থোকা থোকা উজ্জ্বল নাম। আর এদের সঙ্গে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে এসে যোগ দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এরা সকলে মিলে শুধু একটি দেশ দেননি। তারা যে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ওই ভাষা আন্দোলনে যারা জীবন দিলেন— তাঁদের যারা নেতা ছিলেন গাজীউল হক, এম আর আখতার মুকুল, আব্দুস সামাদ (পরবর্তীতে আব্দুস সামাদ আজাদ), জিল্লুর রহমান, হাবিবুর রহমান শেলি প্রমুখ। সুফিয়া আহমদ, রওশনরা বাচ্চুসহ চারজন ছাত্রী প্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলেন।
১৭ অক্টোবরের পরের মূল্যায়ন
১৭ অক্টোবরের সনদ অনুযায়ী ওই দিন থেকে বর্বরতা থেকে সভ্যতার যুগে প্রবেশ করলে এঁদেরকে কোথায় রাখা হবে? কোথায় রাখা হবে হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান প্রমুখকে?
অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানী নাজমুল করিম, সাংবাদিক ও মানবতাবাদী লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন, লেখক শওকত ওসমান— চল্লিশের দশক থেকে বেড়ে ওঠা এই সৃষ্টিশীল মানুষরা ১৭ অক্টোবর ২০২৫-এর পরে কোন খাতায় স্থান পাবেন? সনদ অনুযায়ী তারাও কি…?
গণমাধ্যম ও জাতির বিবেক
বাংলাদেশের মিডিয়ার ওপর অনেকদিন ধরে ভূতের নৃত্য চালাচ্ছে বিভিন্ন সরকার। তারপরেও এ দেশের মিডিয়ার একটি অনেক বড় অবস্থান ছিল।
এদেশের লেখক ও সাংবাদিক আবুল মুনসুর আহমদ সম্পাদক ছিলেন, রাজনীতিকও ছিলেন। সম্পাদক ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী, আব্দুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রমুখ।
তাঁদের ধারা বজলুর রহমানরাও বহন করেছিলেন। রাজনীতি ও দেশসচেতন হিসেবে মানিক মিয়ার মতো সম্পাদক পৃথিবীতেই হাতে গোনা কয়েকজন। জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষও সাংবাদিকতায় পৃথিবীতে খুব কম।
এখন আর তাঁদের পরিচয় লিখে লাভ নেই— এখন শুধু জানা দরকার, ১৭ অক্টোবরের পর থেকে তাঁরা কোন তালিকায় থাকবেন? কারণ তালিকা তো দুটো— একটা ১৭ অক্টোবরের আগের বর্বরদের তালিকা, আরেকটা ১৭ অক্টোবরের পরের সভ্যদের তালিকা।
সভ্যতার সংজ্ঞা ও নির্দেশিকা
আর সভ্য হতে হলে কী গুণ থাকতে হবে, সেটা তো হাজার বছরের অতীতের দিকে তাকালে মানুষ জানতে পারবে না। তাই সভ্য হওয়ার একটা ফর্মুলা বাজারে ছেড়ে দিলে ভালো হতো।
আমরা জুলাইতে নারী মুক্তির অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াতের মুরালে কালি দিতে দেখেছি। যে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে এই দেশ— সেই বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে।
শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সবসময়ই এক ধরনের অশ্লীলতা ছড়ানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙা হয়েছে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ভাঙা হয়েছে। হিন্দুদের মন্দির ভেঙে উৎসব করা হয়েছে। সুফী সাধকদের মাজার ভাঙা শুধু নয়, তাঁদের চুল পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া বলা হয়েছে দেশ ১৯৪৭-এর বন্দোবস্তে যাবে। একারণে কাজী আবদুল ওদুদ, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে সাহস পাচ্ছি না। কারণ ৪৭-এর বন্দোবস্তের পাকিস্তানে তাঁদের ঠাঁই হয়নি।
কমিশনের প্রস্তাব
তাই সব থেকে ভালো হয়— বিদেশি নাগরিকত্ব আছে এমন কোনো একজন এনজিও নেতাকে প্রধান করে যদি একটি কমিশন গঠন করা হয়, যা সভ্যতার দিকনির্দেশনা দেয়।
তাহলে অতীতের দিকে না তাকিয়ে মানুষ ১৭ অক্টোবরকে বেসলাইন ধরে ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী সভ্য হতে পারত।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.