রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, তহবিল সংকোচন ও বিশেষজ্ঞদের প্রতি শত্রুতামূলক পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সম্প্রদায় এক গভীর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক চীনা-আমেরিকান বিজ্ঞানীর কাছে এই পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্ধকার সময়কে—যে সময়ে জ্ঞানচর্চা ছিল অপরাধ, আর চিন্তাশীল মানুষকে করা হতো নিপীড়িত।
যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানচর্চায় ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ ছায়া
১৯৬৬ সালে মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে চীনে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল তথাকথিত ‘বুর্জোয়া প্রভাব’ নির্মূল করা ও ব্যক্তিগত ক্ষমতা সুসংহত করা। এতে চীনের অর্থনীতি, শিক্ষা ও গবেষণার ওপর নেমে আসে এক দশকব্যাপী বিপর্যয়।
আজ সেই ইতিহাস নতুন করে আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রখ্যাত গণিতবিদ শিং-টং ইয়াও জানান, এক মার্কিন অধ্যাপক তাকে বলেছেন, “আমেরিকার একাডেমিক জগৎ এখন প্রায় চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো এক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
সন্দেহ ও নিপীড়নে ক্লান্ত চীনা-আমেরিকান গবেষকরা
একজন মার্কিন জীববিজ্ঞানী, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘চায়না ইনিশিয়েটিভ’-এর সময় তিনি বছরের পর বছর সন্দেহ ও হয়রানির মুখে ছিলেন। কোভিড–উৎপত্তি নিয়ে ভুয়া অভিযোগ, গবেষণাপ্রকল্প বাতিল, এবং সরকারি পর্যালোচনায় ‘ভ্যাকসিন প্রযুক্তি’ শব্দের কারণে অনুমোদন প্রত্যাহার—এসব ঘটনার ফলে তিনি এখন দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
তার ভাষায়, “এখন যা চলছে, তা সম্পূর্ণ উন্মত্ততা। আমি আগামী বছর চীনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছি।”
বাজেট কর্তন ও বিজ্ঞানীদের ছাঁটাই
এই বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকার “অপচয় কমানো”র নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজেট কাটছাঁট করেছে। নাসা থেকে চার হাজার বিজ্ঞানী এবং সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) থেকে শত শত কর্মীকে সম্প্রতি ছাঁটাই করা হয়েছে।
গবেষণা ও বিজ্ঞান প্রশাসনের পুরনো সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণাধীন বৃহত্তর কাঠামোয় একীভূত করার পদক্ষেপ নিয়েছে হোয়াইট হাউস। ফলে বৈজ্ঞানিক স্বাধীনতার জায়গা ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: যখন ‘জ্ঞান’ হয়ে ওঠে অপরাধ
চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মেধাবীদের বলা হতো ‘জনগণের শত্রু’ ও ‘দুর্গন্ধযুক্ত নবম শ্রেণি’। স্লোগান ছিল—“যত বেশি জানবে, তত বেশি বিপজ্জনক।”
চীনা বিজ্ঞান একাডেমি, যা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তখন শতাধিক কেন্দ্র থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র দশটিতে।
চীন-জন্ম বিজ্ঞানী ও সমালোচক ফাং শিমিন সাম্প্রতিক সময়ে লিখেছেন, “ট্রাম্প-যুগের এই নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবেও রাজনীতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে জ্ঞানের ওপরে।”
তিনি উল্লেখ করেন, অক্টোবরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের চার পরিচালককে একযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাঁদের ল্যাব বন্ধ করা হয়েছে—এটি যেন এক নতুন ‘রাজনৈতিক আনুগত্য পরীক্ষা’।
“বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস কোরো না”—নতুন বার্তা
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস সাইমন বলেন, “বর্তমান প্রশাসনের বার্তা স্পষ্ট—বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাস কোরো না। প্রকৃত জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, আর এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র নিজ পায়ে কুড়াল মারছে।”
তবে তিনি যোগ করেন, “চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো সহিংসতা এখনো যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়নি। সেখানে অধ্যাপকদের রাস্তা ঘুরিয়ে অপমান করা হতো, অনেকেই আত্মহত্যা করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি ভয়াবহ, তবে সেই মাত্রায় নয়।”
মেধা হারানোর আশঙ্কা
সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনের বিজ্ঞানচর্চাকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছিল। আজ যুক্তরাষ্ট্রও সেই ঝুঁকির মুখে—বিশেষ করে যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে।
ডেনিস সাইমনের মতে, অনিশ্চয়তা ইতিমধ্যেই অনেক প্রকল্প ও গবেষণাদলকে ভেঙে দিয়েছে। বিদেশি ও মার্কিন বিজ্ঞানীরা আরও স্থিতিশীল অর্থায়নের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
দীর্ঘমেয়াদে এই ধারা যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা ও উন্নয়ন কাঠামোয় “অপূরণীয় ক্ষতি” ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা।
যখন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আনুগত্য বিজ্ঞানচর্চার ওপরে প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন চীন মেধাবীদের স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস যেন নতুন করে এক উল্টো প্রতিচ্ছবি তৈরি করছে—একসময় যে দেশ জ্ঞানবিরোধিতায় ধ্বংস হয়েছিল, এখন সেই চীনই হয়ে উঠছে গবেষণার স্থিতিশীল আশ্রয়স্থল।
#
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ট্রাম্প, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বিজ্ঞানচর্চা, গবেষণা, মেধাপ্রবাহ, সারাক্ষণ রিপোর্ট