দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক ধসের মধ্যেও ভেনিজুয়েলার তেল খাতের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠেছে মার্কিন তেল জায়ান্ট শেভরন। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো খোলাখুলিভাবে এ কোম্পানির প্রশংসা করছেন, আর মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার মাঝেও শেভরনের উপস্থিতি দেশটির অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করছে।
শেভরনের শতবর্ষের উপস্থিতি
শেভরন ১৯২৩ সাল থেকে ভেনিজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে তেল উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার পর, মাদুরো বলেন, “আমি চাই শেভরন এখানে আরও ১০০ বছর থাকুক।”
এই মন্তব্য শুধু কৃতজ্ঞতাই নয়, বরং ইঙ্গিত দেয় যে আমেরিকান পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানটি এখন ভেনিজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক সরকারের জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
নিষেধাজ্ঞার মাঝেও তেল রপ্তানিতে রেকর্ড
সেপ্টেম্বরে ভেনিজুয়েলার তেল রপ্তানি পৌঁছেছে পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, যার পেছনে শেভরনের পুনরায় কার্যক্রম শুরু অন্যতম কারণ। বর্তমানে কোম্পানিটি দেশটির মোট তেল উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশের যোগান দিচ্ছে।
হিউস্টনের রাইস ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিসকো মনালদির মতে, গত দুই বছরে ভেনিজুয়েলার তেল উৎপাদন বৃদ্ধির ৮০ শতাংশই এসেছে শেভরনের প্রকল্পগুলো থেকে।
অর্থনীতিতে টিকে থাকার লড়াই
ভেনিজুয়েলার অর্থনীতি প্রায় পুরোপুরি তেলনির্ভর। অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিসকো রদ্রিগেজ বলেন: ‘তেল রাজস্বই ভেনিজুয়েলার জীবনরেখা।’
শেভরনের কার্যক্রমের কারণে সরকার এখন খাদ্য ও ওষুধের মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দেশটিকে আবারও ভয়াবহ মানবিক সংকটে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করছে।
সমালোচনা ও বিতর্ক
তবে শেভরনের এই ভূমিকা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, কোম্পানিটি কার্যত মাদুরোর স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখছে।
অন্যদিকে, শেভরনের মুখপাত্র বিল টুরেন বলেন, “আমাদের উপস্থিতি স্থানীয় অর্থনীতি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তাকেও শক্তিশালী করছে।”
দ্বৈত কূটনীতির ফায়দা
ওয়াশিংটন ও কারাকাসের উত্তেজনার মাঝেও শেভরন উভয় পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উভয় প্রশাসনই কখনো পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেনি শেভরনের ভেনিজুয়েলা থেকে তেল পাঠানো।
বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে যদি মাদুরো সরকার পতনও ঘটে, তবুও শেভরনের প্রভাব নতুন বিনিয়োগের দৌড়ে তাকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও ঝুঁকি
শেভরন অতীতে উৎপাদন বন্ধ, কর্মী গ্রেপ্তার ও তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণের মতো সংকটে পড়েছে। তবুও তারা দেশ ছাড়েনি।
বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড চাও বলেন, “যদি এই তেল উত্তোলন সহজ হতো, ভেনিজুয়েলাই তা করে ফেলত। কিন্তু অরিনোকো বেল্টের ঘন সালফারযুক্ত তেল উত্তোলনে শেভরনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অপরিহার্য।”
চাভেজ থেকে মাদুরো পর্যন্ত ধারাবাহিকতা
হুগো চাভেজ যখন বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর সম্পদ জাতীয়করণ শুরু করেন, তখন এক্সনমোবিল ও কনোকোফিলিপস দেশ ছাড়ে। কিন্তু শেভরন রয়ে যায়—তখনকার নির্বাহী আলি মোশিরির উদ্যোগে গড়ে ওঠে সেই আস্থার সম্পর্ক।
শেভরন বিশ্বাস করেছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে গেলে তাদের উপস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে। আজ সেই কৌশলই সফল হয়েছে।
শেভরনের উপস্থিতি এখন ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রে। মার্কিন নীতি, মাদুরোর কৌশল এবং বৈশ্বিক তেলবাজারের ওঠানামার মধ্যেও কোম্পানিটি হয়ে উঠেছে এক সেতুবন্ধন—যা একদিকে সমাজতান্ত্রিক কারাকাসকে টিকিয়ে রাখছে, অন্যদিকে আমেরিকার জ্বালানি স্বার্থকেও সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
# ভেনিজুয়েলা,# শেভরন,# তেলনীতি,# মাদুরো, #যুক্তরাষ্ট্র,# নিষেধাজ্ঞা,# অর্থনীতি,# জ্বালানি নিরাপত্তা, #সারাক্ষণ রিপোর্ট