আফগানিস্তান থেকে নির্বাসিত হয়ে বহু বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কিংবদন্তি গায়িকা নাগমা এখনো থেমে যাননি। যুদ্ধ, ক্ষতি ও নির্বাসনের মাঝেও তাঁর কণ্ঠ আজও আফগান জনগণের আশার প্রতীক। লন্ডনের এক সাধারণ হলে অনুষ্ঠিত তাঁর সাম্প্রতিক কনসার্টে প্রবাসী আফগানদের চোখে জল ও গর্বের ঝিলিক — গানের মধ্য দিয়েই তিনি তালেবানের নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।
যুদ্ধ ও ক্ষতির গল্প
নাগমা বলেন, “আমার জীবন কাহিনি খুবই দুঃখের। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই ও তিন বোন — সব ভাই সেনাবাহিনীতে কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। এক বোনও কাবুলে মারা গেছে।”
তবু জীবনের আঘাত তাঁকে থামাতে পারেনি। ষাটের কোঠায় পা রাখা নাগমা এখনো ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা শহরে গান গেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান কাবুল দখলের পর থেকে তিনি আর আফগানিস্তানে গান করেন না — কারণ সেখানে আবার সংগীত নিষিদ্ধ এবং নারীদের প্রকাশ্য জীবনে অংশগ্রহণেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
শিল্পীর প্রতিবাদ ও জনমানুষের আশ্রয়
নাগমা শুধুই গায়িকা নন, তিনি এখন অনেকের কাছে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। আফগান রাজনীতিবিদদের প্রতি অনাস্থা থাকা বহু নাগরিকের কাছে তিনি আজ এক প্রতীক — মানবিক সাহায্য তহবিল গঠন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অনুদান, কিংবা মেয়েদের স্কুল পুনরায় খোলার আহ্বান — সব ক্ষেত্রেই তাঁর গানেই উঠে আসে আশার বার্তা।
২০১৩ সালে তালেবানের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি এক ভিডিওতে সংগীতবিহীনভাবে গেয়েছিলেন।
“আমার স্কুল ধ্বংস কোরো না,
আমাকে পড়াশোনা করতে হবে,
আমি এক আফগান মেয়ে।”
এরপর থেকে তিনি একই বিষয়ের ওপর আরও বেশ কিছু গান লিখেছেন ও গেয়েছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, “গানের মাধ্যমে আমি আমার জাতির প্রতি অনেক বার্তা পৌঁছে দিতে চাই।”
বিতর্ক ও ভুল ধারণা
নাগমাকে ঘিরে বিতর্কও কম নয়। সোভিয়েতপন্থী সরকারের আমলে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংগীত দলের সদস্য ছিলেন — যা তাঁকে পরবর্তীকালে মুজাহিদিনদের নিশানায় পরিণত করেছিল। এমনকি তাঁকে এক সময় একজন যুদ্ধবাজ কর্তৃক অপহরণের গল্পও ছড়ানো হয়, যা তিনি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন।
কিছু সংগীতশিল্পী তাঁকে তালেবানের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন কিংবা অর্থকেন্দ্রিক বলে সমালোচনা করলেও তাঁর জনপ্রিয়তা আজও অটুট।
গানের শুরু ও যাত্রাপথ
দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহারে জন্ম নেওয়া নাগমার আসল নাম শাহ পারি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং স্কুলে জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পান। ১৬ বছর বয়সে কাবুলে গিয়ে রেডিও আফগানিস্তানে অডিশন দেন এবং গানের জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেন।
তিনি “নাগমা” নামটি নেন, যার অর্থ “সুর”। সহশিল্পী ও পরবর্তী সময়ে স্বামী মাঙ্গলের সঙ্গে তিনি একটি বিখ্যাত সংগীতজুটি গড়ে তোলেন।
তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকার সংগীতকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় ব্যবহার করত এবং নাগমার ওপরও ছিল রাজনৈতিক গান গাওয়ার চাপ। সেই সময় তাঁর ছোট বোন গুলপারি নিহত হন — যে হামলাটি মূলত তাঁকেই লক্ষ্য করে হয়েছিল। বোনের মৃত্যুর পর তিনি “Beloved Pilot” নামের বিখ্যাত গানটি রেকর্ড করেন, কিন্তু সেই ভিডিওতে ছিল এক বিধ্বস্ত মুখ, শোকাহত এক শিল্পী।
নির্বাসন, নতুন জীবন ও সংগ্রাম
বোনের মৃত্যুর পর নাগমা সন্তানদের নিয়ে কাবুল ছাড়েন। পাকিস্তান, দুবাই ও সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নেন। এ সময় তিনি মাঙ্গলের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান এবং পরবর্তীতে এক মুজাহিদিন নেতার পুত্র মোহাম্মদ শরীফকে বিয়ে করেন — যদিও সেই সংসারও টেকেনি। বর্তমানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে বোনের সঙ্গে থাকেন এবং প্রবাসী আফগান সম্প্রদায়ের জন্য নিয়মিত গান করেন।
আমেরিকান সামরিক হস্তক্ষেপ চলাকালীন দুই দশকে তিনি কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও কয়েকবার আফগানিস্তান সফর করেছেন, কারণ তালেবান তাঁকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা
লন্ডনের কনসার্টের পর সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্পূর্ণ আশাহীন। আজও মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, নারীদের কোনো অধিকার নেই — এ অবস্থায় আমি কীভাবে গান দিয়ে তাদের আশা দেব?”
তবুও তিনি বলেন, তালেবানের মধ্যেও তাঁর গান শুনে অনেকেই শ্রদ্ধা জানায়।
গানের মাধ্যমে মাতৃভূমির স্মৃতি
লন্ডনের মঞ্চে নাগমা গেয়েছিলেন এক আবেগময় গান —
“এই উচ্চ পর্বতশ্রেণি থেকে,
আমি তোমার ঝুলিতে ভরব
তুঁত ফল, পাইন বাদাম,
আর আশীর্বাদ, উজাড় করে।”
গান শেষ করে তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই তোমাদের আফগানিস্তানের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে — যাতে আমরা একে অপরকে ভালোবাসতে শিখি।”
নাগমার কণ্ঠ আজও আফগান জনগণের আত্মার প্রতিধ্বনি। প্রবাসে থেকেও তিনি যেন সেই হারানো দেশের সঙ্গীতচেতনার ধারক। সংগীত যখন দেশে নিষিদ্ধ, তখন তাঁর প্রতিটি সুরই হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক — যা তালেবানের শাসনেও আফগান সংস্কৃতির ধ্বনিকে বাঁচিয়ে রাখছে।
# আফগানিস্তান,# তালেবান, #নাগমা, #নারীর অধিকার, #সংগীত নিষেধাজ্ঞা, #প্রবাসী সংস্কৃতি, #সারাক্ষণ রিপোর্ট