২০২৫ সাল শেষের পথে এগোতে গিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রতিটি শতাব্দী শুধু প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের পরিবর্তন বা বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলের মাধ্যমেই চিহ্নিত হয় না, বরং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার কাঠামোগত রূপান্তরও এতে বড় ভূমিকা রাখে। বিংশ শতাব্দী ছিল মূলত মার্কিন ডলারের শতাব্দী। তবে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা বদলাতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা ‘ব্লকের সঙ্গে খেলা: বিচ্ছিন্নতার পরিমাপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্য ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দুটি উদীয়মান ব্লকের মধ্যে পুনর্বিন্যাস হচ্ছে। গবেষণার ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়তো আর আগের মতো বৈশ্বিকায়নের পথে ফিরবে না; বরং শক্তিশালী সামষ্টিক আঞ্চলিক কাঠামোর দিকেই ঝুঁকবে।
এই যুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে সামষ্টিক অঞ্চল গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে। কার্যত যুক্তরাষ্ট্র এখন বৈশ্বিক নেতৃত্বের কাঠামো নতুন করে মূল্যায়ন করছে। তাদের লক্ষ্য নিজেদের নেতৃত্বে একটি আত্মনির্ভরশীল সামষ্টিক অঞ্চল গড়ে তোলা, আর এশিয়ার প্রভাবক্ষেত্র অনেকটাই চীনের জন্য ছেড়ে দেওয়া।
আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের একচেটিয়া অবস্থান ধীরে ধীরে দুর্বল হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতে কোন আর্থিক উপকরণ বা সম্পদ সবচেয়ে কার্যকর হয়ে উঠবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিকাশকে যদি উচ্চপ্রযুক্তির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ধরা হয়, তবে জ্বালানিই এখানে সবচেয়ে স্বাভাবিক উত্তর।
জ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর নতুন অর্থনীতি সাশ্রয়ী সম্পদ ও মানবসম্পদের পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার ছাড়া কার্যকরভাবে চলতে পারে না। এমন দেশের সংখ্যা খুবই সীমিত, যাদের একদিকে শক্তিশালী প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তি রয়েছে এবং অন্যদিকে বিজ্ঞান ও শিক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আছে।
এই ক্ষেত্রে চীন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশটি নিজস্ব বৃহৎ ভাষাভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল তৈরি করেছে এবং দ্রুতগতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ বাড়িয়েছে। এই খাতে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। রাশিয়া ও আরও কয়েকটি দেশও আগেভাগেই এই বৈশ্বিক প্রবণতা শনাক্ত করে একই পথে অগ্রসর হচ্ছে।
এর বিপরীতে ইউরোপ ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। সাশ্রয়ী জ্বালানির প্রবেশাধিকার হারাতে থাকায় সেখানে তথ্যকেন্দ্র ও বৃহৎ কম্পিউটিং অবকাঠামোর নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনা কঠিন হয়ে উঠছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে জ্বালানির আবির্ভাব প্রায় নিশ্চিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ, নতুন পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নতুন ধরনের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামো পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করে জ্বালানি।
এই নতুন ব্যবস্থা শুধু জাতীয় মুদ্রায় সীমান্তপাড়ি লেনদেনকে দ্রুততর করতে পারে না, বরং এমন নতুন ডিজিটাল মুদ্রারও জন্ম দিতে পারে, যার মূল্য স্বর্ণের সঙ্গে নয়, বরং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এই অর্থে জ্বালানি অর্থকে প্রতিস্থাপন করে না; বরং অর্থের চেয়েও বেশি মৌলিক একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়।
চীনের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক। গত ৪০ বছরে দেশটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। ১৯৮৫ সালের পর থেকে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৯ হাজার ৬৬১ দশমিক ৯ টেরাওয়াট-ঘণ্টা, যা দুই হাজার ৩০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি। বৈশ্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির প্রায় অর্ধেকই এসেছে চীন থেকে। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে একই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ৭৩০ দশমিক ১ টেরাওয়াট-ঘণ্টা, বা ৬৫ শতাংশ।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশলগত উপাদান হিসেবে পানির গুরুত্ব নিয়েও আলাদা বিশ্লেষণ করেছে। ‘পানি সম্পদের সামষ্টিক গুরুত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তারা কৃষি বা পরিবেশগত দিকের পাশাপাশি পানির সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর জোর দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী সংরক্ষণ সংস্থা ডব্লিউডব্লিউএফের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, পানি ও মিঠাপানির প্রতিবেশব্যবস্থার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ৫৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশের সমান।
জলবায়ু পরিবর্তন এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে। বর্তমান নির্গমন প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় ৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। একই সময়ে ভূ-পৃষ্ঠের মিঠাপানির জলাধারের তাপমাত্রা একবিংশ শতাব্দীর শেষে ১ দশমিক ৩ থেকে ৪ দশমিক ১ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর ফলে শিল্পকারখানার শীতলীকরণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
বর্তমানে গ্রীষ্মকালে বিশ্বব্যাপী স্থাপিত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৭০ শতাংশ সচল থাকে। তবে শতাব্দীর শেষ নাগাদ এই সক্ষমতা ৬ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ইতোমধ্যেই পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও নদীর পানির স্তর কমে যাওয়ায় অনেক উন্নত দেশে তাপবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হচ্ছে।
উচ্চপ্রযুক্তি খাতগুলো এই সংকটে সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। তথ্যকেন্দ্র শীতল রাখতে বিপুল পরিমাণ পানি প্রয়োজন, অথচ পানির স্বল্পতার কারণে অনেক বড় আকারের কম্পিউটিং প্রকল্প বিলম্বিত হচ্ছে কিংবা পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গুরুতর বাধা।
বৈশ্বিক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি মডেল ব্যবহার করে করা গবেষণায় দেখা গেছে, পানি সংকটের কারণে উৎপাদন ক্ষতি মোট দেশজ উৎপাদনের শূন্য দশমিক ২ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, যদি পানির পুনর্বণ্টন না করা হয়। সামষ্টিক আঞ্চলিক পর্যায়ে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ। পানি অর্থনীতিবিষয়ক বৈশ্বিক কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে কাঠামোগত ক্ষতি মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
দেশভিত্তিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ২০২৩ সালের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, যেসব বছরে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, সেসব বছরে ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ২ দশমিক ৮ থেকে ৩ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। একই বছরের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদনের মৌসুমে খরা দেখা দিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া ও চীন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পানিসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য মিঠাপানির দিক থেকেও তারা শীর্ষ পাঁচে অবস্থান করছে।
আলবার্ট বাখতিজিন 


















