প্যারিসের ঐতিহাসিক লুভ্র মিউজিয়ামে রবিবার সংঘটিত চুরিটি হয়তো প্রচলিত অর্থে কোনো শিল্প–চুরি ছিল না। বিশেষজ্ঞদের মতে, চোরেরা লক্ষ্য করেছিলেন শিল্পের সৌন্দর্য নয়, বরং রত্ন ও সোনার মতো সহজে বিক্রিযোগ্য পণ্য।
রত্নভাণ্ডারের পেছনের উদ্দেশ্য
চুরি যাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে ছিল ঐতিহাসিক মূল্যসম্পন্ন বহু গহনা, যার একটি রানি অরটেন্সের পরিধেয় টায়ারা—যাতে ছিল ২৪টি শ্রীলঙ্কান নীলা এবং ১,০৮৩টি হীরকখণ্ড। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চোরেরা এসব রত্ন আলাদা করে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিল, যাতে সেগুলো নতুন গহনায় ব্যবহার করা যায় বিনা চিহ্নে।
লন্ডন পুলিশ বাহিনীর সাবেক আর্ট স্কোয়াড প্রধান ভারনন র্যাপলি বলেন, এটি কোনো “শিল্প চুরি” নয়, বরং “কমোডিটি থেফট”—অর্থাৎ মূল্যবান উপকরণের লোভে সংঘটিত অপরাধ।
নতুন প্রবণতা: জেম ও মেটালের জন্য মিউজিয়াম চুরি
আর্ট লস রেজিস্টারের পরিচালক জেমস র্যাটক্লিফ জানান, এখনকার যুগে চোরেরা মিউজিয়ামের শিল্পকর্ম নয়, বরং গয়না ও ধাতব সংগ্রহের দিকে বেশি আগ্রহী।
তার মতে, “বড় প্রতিষ্ঠানে চুরি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও পুরস্কারও তত বড়।”
র্যাটক্লিফ বলেন, এ ধরনের চোরেরা শিল্পকর্ম ক্ষতির ঝুঁকি তোয়াক্কা করে না, এমনকি কিছু মূল্যবান বস্তু ফেলে রেখে চলে যায়।
এই চুরিতেও তারা নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুট নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে ছিল ৮টি সোনার ঈগল, ২,৪৯০টি হীরা ও ৫৬টি পান্না। তবে নিরাপত্তারক্ষীরা উপস্থিত হওয়ায় চোরেরা সেটি ফেলে পালায়।
কেন বাছাই করা হয়নি বিখ্যাত হীরা
লন্ডন পুলিশের আরেক সাবেক কর্মকর্তা ডিক এলিস জানান, সহজে বিক্রিযোগ্য রত্নের জন্যই হয়তো চোরেরা বিখ্যাত রিজেন্ট ও সানসি হীরা নেয়নি।
অ্যান্টওয়ার্পের ডায়মন্ড কাটার পিটার বম্বেক বলেন, লুভ্র মিউজিয়ামের কাছে হারানো প্রতিটি রত্নের বিস্তারিত ছবি রয়েছে; তাই চুরি হওয়া ছোট হীরকখণ্ডও সহজে শনাক্ত করা সম্ভব। এজন্য সেগুলো পুনরায় কাটতে হবে, যা ঝুঁকিপূর্ণ।
গহনা বিশেষজ্ঞ জোয়ানা হার্ডি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “বাজারে যখন প্রচুর হীরা সহজলভ্য, তখন এমন ছোট পাথর চুরি করা যুক্তিহীন—এটা কেবল নির্বুদ্ধিতার কাজ।”
সম্ভাব্য বিক্রির পথ ও আন্তর্জাতিক চক্র
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চোরেরা হীরাগুলো ইউরোপের বাইরে নিয়ে গিয়ে পুনরায় কাটার পরিকল্পনা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতিহাসে দেখা গেছে, চুরি করা হীরা সাধারণত অ্যান্টওয়ার্পের পাইকারদের মাধ্যমে বিক্রি হয়।
তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে বর্তমানে সেগুলো নানা দেশে পাচার ও বিক্রির সুযোগ অনেক বেড়েছে।
ইউরোপজুড়ে কমোডিটি চুরির উত্থান
গত দুই দশকে ইউরোপের নানা জাদুঘরে এমন ‘কমোডিটি ক্রাইম’-এর ঢেউ দেখা গেছে।
২০১৭ সালে জার্মানির বার্লিনের বোডে মিউজিয়াম থেকে কয়েক মিলিয়ন ইউরো মূল্যের বিশাল সোনার মুদ্রা চুরি হয়।
২০১৯ সালে বার্লিনের এক অপরাধচক্র ড্রেসডেনের রয়্যাল প্যালেসের ‘গ্রিন ভল্ট’ থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরোর রত্ন নিয়ে পালায়।
২০২২ সালে দক্ষিণ জার্মানির এক জাদুঘর থেকে ৪৮৩টি প্রাচীন সোনার মুদ্রা চুরি হয়, যার মূল্য প্রায় ১.৭ মিলিয়ন ডলার।
ব্রিটেনেও ২০১৯ সালে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি ঘটে—ব্লেনহেইম প্যালেস থেকে শিল্পী মরিজিও ক্যাটেলানের তৈরি ১৮ ক্যারেট স্বর্ণনির্মিত টয়লেট চুরি হয়।
ফ্রান্সে নতুন ঢেউ
এখন ফ্রান্সেও শুরু হয়েছে একই ধারা—গহনার দোকান ও জাদুঘর উভয় ক্ষেত্রেই।
মাত্র এক মাস আগে প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি থেকে প্রায় ৭ লাখ ডলারের সোনার টুকরা চুরি হয়।
ডাচ আর্ট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ আর্থার ব্র্যান্ড বলেন, “লুভ্রের মতো জায়গায় চুরি হলে তা গোটা ইউরোপের জাদুঘর জগতে আতঙ্ক ছড়ায় — এখন সবাই ভাবছে, কেউই আর নিরাপদ নয়।”
নিরাপত্তা প্রশ্নে বিতর্ক
ঘটনার পর ফরাসি সংসদ ও সংবাদমাধ্যমে লুভ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে।
ব্র্যান্ডের মতে, কাচের পুরুত্ব বাড়ানো কিংবা অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হলেও চুরি পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়।
আর্ট লস রেজিস্টারের র্যাটক্লিফ বলেন, “মিউজিয়ামগুলোকে এখন জনসাধারণের প্রবেশাধিকার ও নিরাপত্তা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে।”
তিনি রসিকতার ভঙ্গিতে যোগ করেন, “লুভ্র চাইলে জানালাগুলো ইট দিয়ে বন্ধ করে দিতেও পারত, কিন্তু আমরা কেউই চাই না যে জাদুঘরে ঢোকার অনুভূতি ব্যাংকের ভল্টে প্রবেশের মতো হোক।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুরি কেবল এক মিউজিয়ামের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা নয়, বরং ইউরোপে শিল্পের বদলে সম্পদের প্রতি ক্রমবর্ধমান লোভের প্রতীক।
লুভ্রের মতো ঐতিহাসিক স্থানে এমন ঘটনার প্রতিধ্বনি এখন পুরো বিশ্ব শিল্প জগতে নতুন এক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—শিল্পের রক্ষায় কতটা নিরাপদ আমাদের সভ্যতা?
# লুভ্র#_চুরি, #প্যারিস,# আর্ট_ক্রাইম,# জাদু