যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ প্রজন্ম এখন এক কঠিন আর্থিক বাস্তবতার মুখোমুখি। কলেজ শেষে চাকরি পাওয়া কঠিন, ক্রেডিট কার্ড পাওয়া আরও কঠিন—ফলে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন ডেবিট কার্ড বা ‘বাই নাউ, পে লেটার’ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে। অথচ ক্রেডিট ইতিহাস না থাকলে বাসা ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে আর্থিক স্বাধীনতা—সবকিছুই হয়ে পড়ছে চ্যালেঞ্জের।
তরুণদের প্রথম বাধা: ক্রেডিট হিস্টরি না থাকা
নিউ ইয়র্কের স্নাতক ড্যানি বেনসন ভাবতেও পারেননি যে অ্যাপার্টমেন্ট খোঁজা তাঁর জন্য এত কঠিন হবে। কলেজজীবনে ক্রেডিট কার্ড না থাকায় তাঁর কোনো ক্রেডিট ইতিহাস ছিল না। পরে তিনি একটি ক্রেডিট কার্ডের আবেদন করলে ব্যাংক তাঁকে শুধুমাত্র ‘সিকিউর্ড কার্ড’ অফার করে, যেখানে ২০০ ডলার জামানত দিতে হয়। “এতে অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়,” বলেন বেনসন। শেষ পর্যন্ত তিনি কার্ডটি না নিয়ে নিউ ইয়র্কে বাবা-মায়ের বাড়িতে ফিরে আসেন।
২২ বছর বয়সী এই তরুণ বলেন, “মনে হয় যেন কোনো সমাধান নেই। আর অর্থনীতি যেভাবে বদলাচ্ছে, অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।”
জেনারেশন জেডের ক্রেডিট সংকট
বেনসনের মতো পরিস্থিতির মুখে পড়ছেন অনেক তরুণ, বিশেষ করে জেনারেশন জেড—যাদের বয়স এখন কুড়ির কোঠায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়টাই আসলে ক্রেডিট গড়ে তোলার সেরা সময়, কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতা তাঁদের পিছিয়ে দিচ্ছে।
মহামারি-পরবর্তী সময়ের অতিরিক্ত ব্যয়, ছাত্রঋণ পরিশোধে বিলম্ব ও মুদ্রাস্ফীতির চাপে এই প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। একই সঙ্গে চাকরির বাজারে সুযোগ কমে গেছে, এবং ব্যাংকগুলোও নতুনদের জন্য ক্রেডিট পণ্য দিতে অনীহা দেখাচ্ছে।
ফলাফল—এই বছরে জেনারেশন জেডের গড় FICO স্কোর নেমে এসেছে ৬৭৬-এ, যা জাতীয় গড় ৭১৫ থেকে অনেক নিচে। প্রায় ১৪ শতাংশ তরুণের স্কোর ৫০ পয়েন্ট বা তার বেশি কমেছে, যা ২০২০ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন।
আইন ও নীতিমালার প্রভাব
২০০৯ সালের ক্রেডিট কার্ড আইন (Credit CARD Act) তরুণদের সুরক্ষার জন্য তৈরি হলেও, এর ফলে ২১ বছরের নিচের কারও জন্য ক্রেডিট কার্ড পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে, যদি না তাঁর স্থায়ী আয় বা সহ-স্বাক্ষরকারী থাকে। এর কারণে কলেজ শিক্ষার্থীরা সহজে ক্রেডিট হিস্টরি গড়তে পারছেন না।
অন্যদিকে, “বাই নাউ, পে লেটার” ধরনের অ্যাপগুলোও তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও, সময়মতো পরিশোধ না করলে এগুলো ভবিষ্যতে ক্রেডিট স্কোরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ছাত্রঋণ ও স্কোর পতন
FICO-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা জেনারেশন জেডের স্কোর পতনের বড় কারণ।
বেনসন তাঁর মায়ের ক্রেডিট কার্ডে ‘অথরাইজড ইউজার’ হয়ে ক্রেডিট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রথম ছাত্রঋণের কিস্তি সময়মতো না দেওয়ায় তাঁর স্কোর ৪০ পয়েন্ট কমে যায়।
পেশাগত উন্নয়ন সংস্থা AscentUP-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এলি ডানজিগার বলেন, “আজকের তরুণরা এমন এক অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে যেখানে বাড়ি কেনা বা সম্পদ গড়ার সুযোগ সীমিত, ফলে তাঁদের জন্য ক্রেডিট গঠন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।”
ব্যাংকগুলোর নীতিতে পরিবর্তন
ব্যাংকগুলো এখন ঝুঁকি এড়াতে তুলনামূলক নিরাপদ গ্রাহকদের দিকে ঝুঁকছে। জেপিমরগান চেজ, সিটিগ্রুপ ও আমেরিকান এক্সপ্রেসের মতো বড় ব্যাংক এখন প্রিমিয়াম কার্ডে জোর দিচ্ছে, যার বার্ষিক ফি ৮৯৫ ডলার পর্যন্ত। অথচ বেশিরভাগ তরুণ এই উচ্চ-ফি কার্ডের সুবিধা নিতে সক্ষম নন।
ক্যাপিটাল ওয়ান ও ব্যাংক অব আমেরিকা এখনও শুরুর দিকের ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু ‘এন্ট্রি-লেভেল’ কার্ড দিচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতে উচ্চ সুদ, কম রিওয়ার্ড এবং জটিল শর্ত থাকে—যা অনেককে নিরুৎসাহিত করে।
তরুণদের গল্প: প্রত্যাখ্যান ও সংগ্রাম
ক্যালিফোর্নিয়ার ১৯ বছর বয়সী র্যাচেল কিম প্রথম ক্রেডিট কার্ডের আবেদন করেন ব্যাংক অব আমেরিকায়। স্কুলজীবন থেকেই সেখানে সেভিংস অ্যাকাউন্ট থাকলেও, ব্যাংক তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে কারণ তাঁর নিয়মিত আয় বা ক্রেডিট ইতিহাস ছিল না। পরে তিনি ক্যাপিটাল ওয়ানের একটি ‘স্টার্টার কার্ড’ পান এবং এখন প্রতি মাসে ৩,০০০ ডলারের সীমায় তা ব্যবহার করছেন। তবে সময়মতো বিল দিতে না পারার ভয় সবসময়ই থাকে।
আরেক তরুণী, গ্যাব্রিয়েলা গুডেন (২৩), হাইস্কুলে থাকাকালে বাবার ক্রেডিট কার্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মহামারির সময় তাঁর বাবা চাকরি হারালে এবং বিল বকেয়া পড়ে গেলে, তাঁর ক্রেডিট স্কোরও কমে যায়। এখন স্নাতক শেষ করেও চাকরি না পেয়ে তিনি নিউ ইয়র্কের হাডসন ভ্যালিতে বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকছেন।
বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ
এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক জেনারেশন জেড সদস্যই জানেন না কীভাবে ক্রেডিট স্কোর কাজ করে, আর প্রতি পাঁচজনের একজন কখনও নিজের স্কোর চেক করেননি। অনেকে বলেন, স্কোর দেখার বিষয়টি তাঁদের উদ্বেগ বাড়ায়; ফলে ৬০ শতাংশেরও বেশি তরুণ একে এড়িয়ে চলেন।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত বিল পরিশোধ, কম ব্যালান্স রাখা, খরচ নজরে রাখা এবং বাড়িভাড়া বা ইউটিলিটি বিলের মতো পুনরাবৃত্ত পেমেন্টের মাধ্যমে ক্রেডিট ইতিহাস গড়া সম্ভব।
আর্থিক উপদেষ্টা স্কট ওয়ার্ড বলেন, “ক্রেডিট স্কোর মূলত ধারাবাহিকতা পছন্দ করে, টাকার পরিমাণ নয়। ছোট ছোট সচেতন পদক্ষেপই বড় সাফল্য আনে।”
শেষ পর্যন্ত ড্যানি বেনসন নিউ ইয়র্কে একটি অ্যাপার্টমেন্ট পান, তবে সেটা তাঁর নিজের ক্রেডিটের কারণে নয়—রুমমেটের বাবা-মা লিজে সহ-স্বাক্ষর করেছিলেন।
বেনসন বলেন, “সবাই বলে আমরা টাকার ব্যাপারে খারাপ, কিন্তু এটা দায়িত্বের ব্যাপার নয়। মনে হয় যেন আমরা এমন এক পরীক্ষায় বসেছি, যার অর্ধেক পৃষ্ঠা নেই।”
#যুক্তরাষ্ট্র, #অর্থনীতি,# ক্রেডিট স্কোর, #জেনারেশন জেড,# তরুণদের আর্থিক সংকট,# ছাত্রঋণ, #ব্যাংকিং নীতি, #সারাক্ষণ রিপোর্ট