জুলাই–আগস্ট ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাড়ছে উদ্বেগ। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে বক্তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন।
আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সম্মেলনের আয়োজন
২০২৫ সালের ২৯ অক্টোবর (বুধবার) নিউইয়র্ক সময় সকাল ৯টায় “টার্নিং পয়েন্ট: জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ” শীর্ষক এক দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এই সম্মেলনের আয়োজন করে কানাডার গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্স এবং বেলজিয়ামের সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরাম। সহযোগী হিসেবে যুক্ত ছিল পোল্যান্ডের নেভার এগেইন অ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাজ্যের ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম ও ৭১@হার্ট, ভারতের রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ, যুক্তরাষ্ট্রের একাত্তরের প্রহরী ও সেন্টার ফর ইউএস–বাংলাদেশ রিলেশনস, সুইজারল্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর সেক্যুলার বাংলাদেশ ও সেন্টার ফর জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট।

মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ
সম্মেলনে বক্তারা গত ১৫ মাসে বাংলাদেশের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, যাতে এসব ঘটনার প্রতি দ্রুত দৃষ্টি দেওয়া হয় এবং বিচার নিশ্চিত হয়।
একই সঙ্গে বক্তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সমালোচনা
সম্মেলনে আলোচিত হয় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের (OHCHR) বাংলাদেশে জুলাই–আগস্ট ২০২৪ সালের বিক্ষোভ-সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন।
বক্তারা প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত অস্পষ্টতা, পক্ষপাত, ভারসাম্যহীনতা এবং বিশ্লেষণগত দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা করেন। তাদের অভিযোগ—প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের নিজস্ব সম্পাদনা নীতিমালা মানেনি এবং যথাযথ প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপনেও ব্যর্থ হয়েছে।
সম্মেলনের ঘোষণা ও প্রস্তাবনা
সম্মেলনে আলোচনার ভিত্তিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ও সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়—
নাগরিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার
বক্তারা বলেন, নাগরিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। বিচারব্যবস্থা যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সমতার ভিত্তিতে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি নিশ্চিত
বিচারবহির্ভূত হত্যা, আটক, নির্যাতন, নারী ও শিশু নির্যাতন, সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর সহিংসতার সব অভিযোগের নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়।
পাশাপাশি, প্রতিটি ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের সুরক্ষা
গণমাধ্যমে সেন্সরশিপ, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ভয়ভীতি ও কারাবাসের নিন্দা জানানো হয়। বক্তারা অবিলম্বে এসব নির্যাতন বন্ধ ও সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
চরমপন্থা মোকাবিলা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা চরমপন্থার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। তারা বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিশ্চিত না হলে টেকসই শান্তি, ও স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।
অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন
সম্মেলনে জোর দেওয়া হয়—বাংলাদেশে একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। এতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ও জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।

বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বক্তাদের অংশগ্রহণ
সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন—
যুক্তরাষ্ট্রের রেভারেন্ড ড. রবার্ট বি. লানসিয়া,
কানাডার উইলিয়াম স্লোন,
ভারতের সাবেক হাইকমিশনার প্রফেসর বীণা শিকরি,
বেলজিয়ামের পাওলো কাসাকা,
যুক্তরাজ্যের ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন ও অ্যালান রাইডস,
সুইজারল্যান্ডের শার্লট জ্যাকোমার্ট,
ভারতের সুহাস চাকমা,
পোল্যান্ডের নাতালিয়া সিনেয়েভা,
জাপানের শুন-ইচি ফুজিকি,
ক্যামেরুনের ড. চংসি আয়াহ জোসেফ,
উগান্ডার প্রফ. ড. রাফাল প্যানকোভস্কি,
যুক্তরাজ্যের পুষ্পিতা গুপ্তা,
যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. নূরান নবি,
নিউজিল্যান্ডের প্রফ. ড. এম. আবদুর রশিদ,
যুক্তরাষ্ট্রের প্রফ. ড. মোহাম্মদ শাহিদুল্লাহ,
ফ্রান্সের ড. এস. এম. মাসুম বিল্লাহ,
যুক্তরাষ্ট্রের ড. মো. আবু নাসের,
জার্মানির ব্যারিস্টার তপস কান্তি বাউল এবং
সুইজারল্যান্ডের খলিলুর রহমান মামুন।
সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ড. মো. হাবিবে মিল্লাত, প্রেসিডেন্ট, গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্স, কানাডা।
মিডিয়া পার্টনার ও পরিচালনা
সম্মেলনের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে যুক্ত ছিল—
গ্লোবাল বাংলা (UK), ব্রিজ বাংলা ২৪ (UK), ন্যারেটিভা ৩৬০ (UK), এনআরবি নিউজ ২৪ (UK), আলফা টিভি (কানাডা), প্রবাস দর্পণ (UK), দৃষ্টিকোণ ৭১ (কানাডা) এবং বাংলা নিউজ নেটওয়ার্ক (USA)।
সম্মেলনের সঞ্চালক ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রিয়জিত দেবসঙ্কর, যুক্তরাষ্ট্রের ইঞ্জি. রানা হাসান মাহমুদ ও ভারতের দেবাদ্যুতি দাশগুপ্তা। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কানাডার গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্সের নির্বাহী পরিচালক মো. গোলাম কিবরিয়া।
সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া, যাতে বাংলাদেশে ন্যায়, স্বাধীনতা ও নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত হয়।
#বাংলাদেশ #গণতন্ত্র #মানবাধিকার #আন্তর্জাতিকসম্মেলন #জুলাইআগস্টঅভ্যুত্থান #গ্লোবালসিডিজি #SouthAsiaDemocraticForum
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















