ব্যাকটেরিয়া হত্যাকারী ভাইরাসের চিকিৎসা সম্ভাবনা
অতি ক্ষুদ্র ভাইরাস, যেগুলো শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত করে এবং হত্যা করতে সক্ষম— সেগুলোই হয়তো একদিন মানবদেহের প্রাণঘাতী সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার হবে। সাম্প্রতিক এক মধ্যপর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ভাইরাসভিত্তিক থেরাপি (ব্যাকটেরিওফাজ) অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস সংক্রমণে কার্যকর হতে পারে।
গবেষণায় ৪২ জন রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাদের রক্তের সংক্রমণ শরীরের টিস্যুতেও ছড়িয়ে পড়েছিল— যা চিকিৎসকদের মতে সবচেয়ে জটিল এবং বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণগুলোর একটি।
ভাইরাস থেরাপিতে আশাজাগানো ফলাফল
রোগীদের দুই-তৃতীয়াংশকে শিরায় (ইন্ট্রাভেনাস) ‘ব্যাকটেরিওফাজ ককটেল’ দেওয়া হয়, যা উন্নয়ন করেছে আর্মাটা ফার্মাসিউটিক্যালস্। বাকি রোগীরা পেয়েছিলেন প্লাসিবো চিকিৎসা। তবে সবাইকে সর্বোত্তম অ্যান্টিবায়োটিকও দেওয়া হয়েছিল।
ফলাফল দেখায়— যারা ভাইরাস থেরাপি ও অ্যান্টিবায়োটিক একসাথে পেয়েছেন, তাদের সুস্থতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ১২তম দিনে দেখা যায়, ভাইরাস চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া রোগীর হার ৮৮ শতাংশ, যেখানে প্লাসিবো গ্রুপে তা মাত্র ৫৮ শতাংশ।
এছাড়া ভাইরাস চিকিৎসা পাওয়া রোগীদের মধ্যে পুনঃসংক্রমণ ও চিকিৎসা ব্যর্থতার হার কম, রক্তে ব্যাকটেরিয়া নেগেটিভ হওয়ার সময়ও দ্রুততর, এবং হাসপাতালে অবস্থানের সময়ও কম ছিল।

চিকিৎসায় নতুন যুগের দিগন্ত
গবেষণা-নেতা ড. লরেন মিলার বলেন, “এই ফলাফলগুলো ফেজ-৩ ট্রায়ালের জন্য শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে এবং ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ভবিষ্যতে ব্যাকটেরিওফাজ থেরাপি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের চিকিৎসায় নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “উচ্চ বিশুদ্ধতা-সম্পন্ন ফেজ-ভিত্তিক থেরাপি একদিন হয়তো জীবনঘাতী সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর সমাধান হিসেবে দাঁড়াবে।”
ইয়েলো ফিভার ও টিক-বাহিত ভাইরাস ঠেকাতে নতুন কৌশল
গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, দুটি নতুন ভাইরাস— ইয়েলো ফিভার ও টিক-বাহিত এনসেফালাইটিস— প্রতিরোধে পরীক্ষামূলক ‘ডিকয় মলিকিউল’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব মলিকিউল ভাইরাসকে মানব কোষে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।
তারা জানান, এই ভাইরাসগুলো মূলত মানুষের কোষের পৃষ্ঠে থাকা ‘লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন রিসেপ্টর’ (LDLR) নামের প্রোটিন ব্যবহার করে প্রবেশ করে। এই প্রোটিনগুলোর কিছু রূপ যেমন LRP1, LRP4, VLDLR ও LRP8 ভাইরাসের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে।
যখন এসব রিসেপ্টর প্রোটিন সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন ভাইরাস কোষে প্রবেশ করতে পারে না। গবেষকরা তাই এমন ‘ডিকয়’ অণু তৈরি করেছেন যা এসব প্রোটিনের অনুকরণ করে ভাইরাসকে বিভ্রান্ত করে— ফলে কোষ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব ডিকয় মলিকিউল মানব ও ইঁদুর কোষে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এবং ইঁদুরে ইয়েলো ফিভার ভাইরাসের প্রাণঘাতী প্রভাব থেকেও রক্ষা দিয়েছে।
ড. মাইকেল ডায়ামন্ড বলেন, “আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে কীভাবে ভাইরাস কোষে প্রবেশ করে— এই পথগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়াও ঠেকানো সম্ভব।”

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী বায়োফিল্ম ঠেকাতে নতুন ধারণা
গবেষকরা আরও এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা জানিয়েছেন— কীভাবে পসিউডোমোনাস অ্যারুজিনোজা নামের ব্যাকটেরিয়া নিজেদের ঘন কমিউনিটিতে (বায়োফিল্মে) সংগঠিত করে টিকে থাকে, যা অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য প্রায় অদম্য হয়ে ওঠে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতিমধ্যেই এই ব্যাকটেরিয়াকে মানবস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি ব্যাকটেরিয়া নিজের প্রজাতির পূর্ববর্তী সদস্যদের রেখে যাওয়া ‘চিনির পথচিহ্ন’ শনাক্ত করে সেই দিকেই গঠন তৈরি করে। তাদের শরীরের সূক্ষ্ম ‘পিলি’ নামের লোমশ অংশ এই চিনি শনাক্ত করে এবং তা রাসায়নিক সংকেতে রূপান্তর করে— যা পরবর্তীতে নতুন বায়োফিল্ম গঠনে ভূমিকা রাখে।
ড. জেরার্ড ওয়ং বলেন, “আমরা প্রথমবার দেখছি কীভাবে ব্যাকটেরিয়া তাদের সূক্ষ্ম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে পারিপার্শ্বিক তথ্য শনাক্ত করে রাসায়নিক সংকেত তৈরি করে।”
সহ-গবেষক উইলিয়াম শ্মিড্ট যোগ করেন, “এই জ্ঞান ভবিষ্যতে এমন চিকিৎসা উদ্ভাবনে সহায়তা করতে পারে, যা ব্যাকটেরিয়াকে সহজে অ্যান্টিবায়োটিক-সংবেদনশীল করে তুলবে।”
চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই ধারাবাহিক আবিষ্কারগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে— ভাইরাস, জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ও আণবিক স্তরের গবেষণাই আগামী দশকে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট
#ভাইরাসথেরাপি #ব্যাকটেরিওফাজ #অ্যান্টিবায়োটিকপ্রতিরোধ #চিকিৎসাবিজ্ঞান #জীববিজ্ঞান #গবেষণা #স্বাস্থ্যঅগ্রগতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















