বিএনপির আপিল শুনানি: সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি
সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আপিল বিভাগে বিএনপির শুনানি শেষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আবেদন জানান।
বুধবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে মামলার অষ্টম দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শুনানিতে কাজল বলেন,
“তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ফলে জাতির ভাগ্যে অমানিশা নেমে এসেছে। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, তাই আমরা এর পুনর্বহাল চাই।”
দীর্ঘ শুনানির পটভূমি
২১ অক্টোবর শুরু হয় এই মামলার শুনানি, যা পরবর্তী কয়েকদিন ধরে চলতে থাকে।
- • ২১-২২ অক্টোবর: বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি করেন ড. শরীফ ভূঁইয়া।
- • ২৩ অক্টোবর: তৃতীয় দিনের শুনানি।
- • ২৮ অক্টোবর: জামায়াতে ইসলামী পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট শিশির মনির।
- • ২৯ অক্টোবর, ৩ ও ৪ নভেম্বর: বিএনপির আইনজীবীরা তাদের যুক্তি তুলে ধরেন।
২৭ আগস্ট, আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেয়। বেঞ্চ জানায়, বিষয়টি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানি হবে।
প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ
শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি বলেন,
“তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে আমরা সাময়িক সমাধান দিতে চাই না। এমন একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োজন যা নির্বাচনকালীন সময়ে গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল রাখবে ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংকট এড়াতে সহায়ক হবে।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি এই ব্যবস্থা ফেরানো হয়, সেটি কার্যকর হবে কবে থেকে?
রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক বলেন,
“গত দেড় দশকে জনগণ শাসিত নয়, বরং শোষিত হয়েছে। গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন—সবই প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের ফল।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন,
“জনগণের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করলে বিপ্লব অনিবার্য হয়। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানও একই কারণে ঘটেছিল।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস
- • ১৯৯৬: সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়।
- • ১৯৯৮: তিন আইনজীবী এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন।
- • ২০০৪: হাইকোর্ট এটিকে বৈধ ঘোষণা করে রিট খারিজ করে দেয়।
- • ২০০৫: আপিল বিভাগে আপিল হয়; আদালত ৮ জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন।
- • ২০১১ সালের ১০ মে: সাত বিচারপতির বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে।
- • পরবর্তীতে পাস হয় পঞ্চদশ সংশোধনী, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে।
এরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হয়।
নতুন করে রিভিউ আবেদন
২৭ আগস্ট ২০২৪-এ সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিভিউ আবেদন করেন।
পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, এবং মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন করেন।
চারটি রিভিউ আবেদন একত্রে শুনানির জন্য গ্রহণ করে আপিল বিভাগ।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য: ‘রায়টি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার বলেন,
“তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লেখা হয়েছিল, যাতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল সুবিধা পায়।”
তিনি অভিযোগ করেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রায় ঘোষণার পর তা বদলেছিলেন, যা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ সময় তিনি আরও বলেন,
“আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু গণতন্ত্রের নামে কোনো মুখোশ চাই না। মুক্তিযুদ্ধের তিন বছর পরই আমাদের গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল।”
অ্যাটর্নি জেনারেলের পদত্যাগ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা
বুধবার শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
অফিসের কনফারেন্স কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন,
“আমি অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেব এবং বিএনপির কাছে নমিনেশন চেয়েছি।”
তিনি জানান, তিনি ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। বিএনপি এখনো ওই আসনে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার আগে তিনি ছিলেন বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, পরে সেই পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সরকারি পদে যোগ দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধান, আপিল বিভাগ, বিএনপি, অ্যাটর্নি জেনারেল, রিভিউ আবেদন, প্রধান বিচারপতি, বাংলাদেশ নির্বাচন, আসাদুজ্জামান, রুহুল কুদ্দুস কাজল, ত্রয়োদশ সংশোধনী, পঞ্চদশ সংশোধনী, আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র, আদালত শুনানি, বদিউল আলম মজুমদার, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সুজন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















