অশ্বগন্ধা কি সত্যিই আমার ‘কর্টিসল ফেস’ সারাবে?
গত এক বছরে লক্ষ্য করলাম, আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনগুলো বদলে গেছে। অ্যালগরিদম হয়তো বুঝে ফেলেছে যে আমি চল্লিশের কোঠায় প্রবেশ করছি। ফলে পেরিমেনোপজ ও মেনোপজ-সংক্রান্ত ভিটামিন, সাপ্লিমেন্ট ও তথাকথিত ‘ন্যাচারাল রেমেডি’-র বিজ্ঞাপন যেন ঝড়ের মতো এসে পড়ল আমার ফিডে।
এই বিজ্ঞাপনগুলোর ভাষা সাধারণত অস্পষ্ট—যেমন “ব্রেন ফগ” বা ঘুমের সমস্যা, যা এসব সাপ্লিমেন্ট নাকি সহজেই দূর করে দিতে পারে। অনেক সময় নির্মাতারা #ad হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীরা (influencers) এসব পণ্য এমনভাবে প্রচার করেন, যেন সেগুলো তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। স্পনসর্ড কনটেন্টের ঘোষণা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তা সচরাচর মানা হয় না।
সন্দেহ আর প্ররোচনার দ্বন্দ্ব
আমি সব সময় বিজ্ঞাপিত পণ্যের বিষয়ে সতর্ক থাকি। তবুও একটানা এসব বার্তা শুনতে শুনতে একসময় ভাবতে শুরু করলাম, হয়তো আমারও পেরিমেনোপজ শুরু হয়েছে। বার্ষিক চেকআপে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে বিষয়টি জানালে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কোনো উপসর্গ আছে? মাসিক চক্রে পরিবর্তন?” তখন বুঝলাম, আমি আসলে কেবল কর্মজীবী দুই সন্তানের মা হিসেবে ক্লান্ত—তার বাইরে বিশেষ কিছু নয়।
২০২১ সালে এই বিষয়ে আমার নিজস্ব প্রতিবেদনের সময় জেনেছিলাম, পেরিমেনোপজ নির্ণয় করা কঠিন। ৩৪টিরও বেশি উপসর্গ থাকতে পারে, কিন্তু অনেক চিকিৎসকই যথাযথ প্রশিক্ষণ পান না। এই শূন্যস্থানকেই কাজে লাগাচ্ছে তথাকথিত ‘বিগ ওয়েলনেস’ শিল্প।

সামাজিক মাধ্যম ও স্ব-চিকিৎসার সংস্কৃতি
যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যবীমা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসার খরচ বাড়ছে। ফলে অনেকেই দৈনন্দিন অসুখবিসুখ নিজেই সামলাতে বাধ্য হচ্ছেন। মানুষ এখন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য মূলত সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই পায়, এমনকি না চাইলেও তা চোখের সামনে এসে পড়ে।
এখানেই শুরু হয় সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ—প্রমাণহীন ও অতিরঞ্জিত দাবির ভিড়ে আসল তথ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
নিয়ন্ত্রণহীন সাপ্লিমেন্ট বাজার
যুক্তরাষ্ট্রে দুটি সংস্থা—এফডিএ (Food and Drug Administration) ও এফটিসি (Federal Trade Commission)—এই শিল্প নিয়ন্ত্রণের কথা। কিন্তু ১৯৯৪ সালের Dietary Supplement Health and Education Act আইনটি কার্যত এফডিএ-র হাত বেঁধে রেখেছে। ফলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই তাদের পণ্যের নিরাপত্তা ও লেবেল যাচাইয়ের দায়িত্ব নেয়।
ওষুধের মতো সাপ্লিমেন্টকে বাজারজাত করার আগে কোনো ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা বা অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। কোনো সমস্যা দেখা দিলে সরকার পদক্ষেপ নিতে বছর লেগে যায়। অন্যদিকে এফটিসি-র দায়িত্ব হলো বিজ্ঞাপনে ভুয়া দাবি ঠেকানো, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপকতার কারণে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইনফ্লুয়েন্সার যুগে বিপণনের ঝড়
এই বিজ্ঞাপনের বন্যা শুধু নারীদের জন্য নয়; পুরুষদের জন্যও ওজন কমানো ও পেশী গঠনের নানা সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে। কিশোরদের জন্য এসব পণ্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও ভয়ংকর।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, টিকটকে ডায়েট-সম্পর্কিত জনপ্রিয় ভিডিওগুলোর বড় অংশেই প্রমাণহীন স্বাস্থ্যদাবি করা হয়, যা ব্যবহারকারীদের মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকিতে ফেলে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এসব সাপ্লিমেন্টে গুণগত মান ও উপাদান নিয়ন্ত্রণের অভাব, এমনকি নিষিদ্ধ ওষুধের উপস্থিতিও থাকতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি মাসে প্রায় ১.৫ কোটি মার্কিন নাগরিক এমন উদ্ভিদজাত সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন যা যকৃতের জন্য বিষাক্ত হতে পারে। অধিকাংশ মানুষ ডাক্তারকে এসব ব্যবহারের কথা বলেন না, কারণ তারা একে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না।
সরকার ও রাজনীতির দ্বিমুখী ভূমিকা
বর্তমান স্বাস্থ্য ও মানবসেবা মন্ত্রী রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়র সম্প্রতি সাপ্লিমেন্ট শিল্পে নতুন উপাদান অনুমোদনের ফাঁকফোকর বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে তিনি নিজেই আবার ‘ভিটামিন এ’ সাপ্লিমেন্টকে হামের প্রতিরোধক হিসেবে প্রচার করেছেন—যা বিভ্রান্তিকর এবং টিকা নেওয়ার আগ্রহ কমাতে পারে।
তাছাড়া তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকেই সাপ্লিমেন্ট ব্যবসায় জড়িত। যেমন সেন্টার ফর মেডিকেয়ার অ্যান্ড মেডিকেইড সার্ভিসেসের পরিচালক মেহমেত ওজ ও সার্জন জেনারেল প্রার্থী কেসি মিন্স—দু’জনেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব পণ্য প্রচার করেছেন। অথচ তারাই আবার ‘বিগ ফার্মা’-র প্রভাবের সমালোচনা করেন।
নারীদের স্বাস্থ্য বাজেট কমছে
২০২৬ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে নারীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক অফিসের বরাদ্দ ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার কমানো হচ্ছে। ফলে নারীদের বার্ধক্যজনিত পরিবর্তন নিয়ে সরকারি গবেষণা ও দিকনির্দেশনা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
তবু এক জিনিসের অভাব হবে না—গোলাপি প্যাকেটের আকর্ষণীয় ‘গামি বিয়ার’ সাপ্লিমেন্ট বিক্রেতা অসংখ্য ইনফ্লুয়েন্সারের।
‘বিগ ওয়েলনেস’ আসলে এক নতুন ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য, যা নারীদের অনিশ্চয়তা ও শরীরের পরিবর্তনকে পুঁজি করে গড়ে উঠছে। চিকিৎসা ও বিজ্ঞান যেখানে পিছিয়ে, সেখানেই বাজার প্রবেশ করছে। কিন্তু সত্যিকারের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন সঠিক গবেষণা, সচেতনতা ও স্বচ্ছ নীতি—শুধু চকচকে বিজ্ঞাপন নয়।
#মধ্যবয়সীনারী #বিগওয়েলনেস #নারীরস্বাস্থ্য #সাপ্লিমেন্ট #সোশ্যালমিডিয়া #স্বাস্থ্যসংস্কৃতি #menopause #wellnessbusiness #healthpolicy
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















