অস্বাভাবিক পরিবারে বেড়ে ওঠা
গ্যাব্রিয়েল হ্যামিল্টন বড় হয়েছেন এমন এক পরিবারে, যাদের বলা যায় সচেতনভাবে “অস্বাভাবিক।” তার মা ছিলেন কঠোর ও শীতল-স্বভাবের নারী, যার প্রিয় শব্দ ছিল “না।” অন্যদিকে তার বাবা ছিলেন আকর্ষণীয় কিন্তু স্বার্থপর একজন মানুষ—যিনি এক প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের স্মরণসভায় শীতল কণ্ঠে বলেছিলেন, “একজনকে হারাতেই হলে অন্তত সেইজনকেই হারালাম, যাকে সবচেয়ে কম পছন্দ করতাম।”
এই দুই বিপরীত চরিত্রের অভিভাবক সন্তানদের মধ্যে মৌলিকতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্যবোধ গেঁথে দিয়েছিলেন। গ্যাব্রিয়েল ছিলেন পাঁচ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ, প্রাণবন্ত ও জেদী মেয়ে।
তার স্মৃতিকথা “Next of Kin”-এ গ্যাব্রিয়েল লিখেছেন, “আমাদের বাড়িতে চোষনি, শিশুখাদ্য, প্লাস্টিকের খেলনা, চিনি মেশানো সিরিয়াল, বা অলস রবিবার সকালের কার্টুনের জায়গা ছিল না। বরং আমাদের ঘরে ছিল নাকাশিমা কফি টেবিল, স্টুবেন কাচ, আর ঘরে তৈরি গ্রানোলা।”
এক শিল্পী পরিবার, এক ধীরে ধীরে ভাঙা সম্পর্ক
পেনসিলভেনিয়ার নিউ হোপ শহরের এই হ্যামিল্টন পরিবার ছিল এমন এক শিল্পীমনস্ক সমাজের প্রতীক, যারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ম বানায় এবং নিজেরাই তা ভাঙে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার পথ শেষ হয়েছিল ভাঙনের মধ্য দিয়ে।
তার প্রথম বই “Blood, Bones & Butter” (২০১১)-এ তিনি শৈশবের জটিলতা নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে লিখেছিলেন। এবার নতুন বই “Next of Kin”-এ তিনি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন পরিবারের ভাঙনের দীর্ঘ যাত্রা—একটি “রঙিন, প্রাণবন্ত, কিন্তু বিপজ্জনক” পরিবারের ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কাহিনি।
তিনি লিখেছেন, “একটি পরিবার একদিনে ভেঙে পড়ে না। এটি ধীরে ধীরে, অদৃশ্য গ্যাসের মতো ক্ষয়ে যায়—যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড ধীরে ধীরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কেউ টের পায় না।”
ভাইয়ের আত্মহত্যা: এক নীরব বিস্ফোরণ
তার ভাই জেফ্রি, ৫৭ বছর বয়সী, হাসিখুশি এক মানুষ ছিলেন, যিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন কাঠ কেটে। একদিন তিনি বনের দিকে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। গ্যাব্রিয়েলের মতে, এর পেছনে কোনো এক অদৃশ্য ‘গ্যাস’—পরিবারের ভেতরে জমে থাকা মানসিক বিষাক্ততা—দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিল।
পিতামাতার ভূমিকা ও পরিবারের দূরত্ব
গ্যাব্রিয়েলের বাবা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি সন্তানদের অনুপ্রাণিত করতেন আবার তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও করতেন। যখন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তার রেস্টুরেন্ট Prune-এর প্রশংসাসূচক রিভিউ প্রকাশ করে, তখন বাবা শীতল স্বরে বলেন, “তোমার চেয়ে ভালো প্রতিভা আরও অনেক আছে, তারা কেন তোমাকেই বেছে নিল বুঝি না।”
মা-ও ছিলেন দূরত্ব তৈরি করা এক চরিত্র। জেফ্রি আত্মহত্যার আগে মাকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মায়ের উত্তর ছিল, “আমি তোমাকে দেখতে চাই না।” গ্যাব্রিয়েল লিখেছেন, “ওই কথাগুলো পড়ে আমি চমকে উঠেছিলাম—আংশিকভাবে মাকে রক্ষা করার প্রবৃত্তি থেকে, কিন্তু মূলত কারণ, ও কথাগুলিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম।”
বোনের স্বামীকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিপর্যয়
বইয়ের মাঝামাঝি হঠাৎ করেই তিনি দ্বিতীয় এক বিপর্যয়ের কথা জানান—তার বিবাহবিচ্ছেদের বিশৃঙ্খলার মধ্যে তিনি নিজের বোন মেলিসার স্বামী (২৩ বছরের সংসার) এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
এখানে গ্যাব্রিয়েল নিজের কাজের ব্যাখ্যা দেন না, বরং বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যান। অন্যদের দুর্বলতা তিনি যতটা খোলামেলাভাবে বর্ণনা করেন, নিজের আচরণের ক্ষেত্রে ততটাই নীরব। তবে তিনি স্বীকার করেন যে এটি একটি ভয়াবহ ভুল ছিল—যা তার জীবনের মূল্যবোধকে নাড়িয়ে দেয়।
সম্পর্কচ্ছেদ ও মানসিক শীতলতা
গ্যাব্রিয়েলের জীবনে “ঠান্ডা দূরত্ব” যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কৈশোরে এক ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়ার পর তিনি চল্লিশ বছর তার সঙ্গে কথা বলেননি। মায়ের সঙ্গে ৩০ বছরের সম্পর্কচ্ছেদ। এমনকি বৃদ্ধ পিতার মৃত্যুর আগ পর্যন্তও যোগাযোগ রাখেননি—শুধু মৃত্যুশয্যায় একটি বার্তা রেখে গেছেন।
সমাপ্তি ও আত্মপ্রতিকৃতি
বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তিনি অসুস্থ মায়ের সঙ্গে পুনর্মিলিত হন এবং নিজেকে গ্রিক পুরাণের চরিত্র অ্যান্টিগোনির সঙ্গে তুলনা করেন—যিনি পরিবারকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। কিন্তু সমালোচকের মতে, এই তুলনা মানা কঠিন। গ্যাব্রিয়েল তার পরিবারকে সমাহিত করেননি, বরং বইয়ের মাধ্যমে আবার জীবিত করেছেন—যাতে তাদের গল্পের শেষ লিপি তার নিজের কলমে লেখা থাকে।গ্যাব্রিয়েল হ্যামিল্টনের “Next of Kin” শুধুমাত্র একটি আত্মজীবনী নয়—এটি এক পরিবারের ভাঙন, সম্পর্কের জটিলতা, এবং আত্মস্বীকারোক্তির গভীর বিবরণ। লেখক নিজের অতীতের ক্ষত উন্মোচন করেছেন, তবে নিজের অপরাধবোধের মুখোমুখি হতে দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছেন। তবুও, এই বই তার জীবনের মতোই—অগোছালো, তীব্র, এবং নির্মমভাবে সত্য।
#গ্যাব্রিয়েলহ্যামিল্টন #আত্মজীবনী #NextOfKin #রন্ধনশিল্পী #পরিবারেরভাঙন #সাহিত্যবিশ্লেষণ #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















