হঠাৎ দাম দ্বিগুণ, বিপাকে নগরবাসী
ঢাকায় পেঁয়াজের বাজারে আবারও লেগেছে অগ্নিসংযোগ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি প্রতি ৭০ টাকা থেকে দাম পৌঁছেছে ১২০ টাকায়। খুচরা ও পাইকারি—দুই বাজারেই দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, ফলে রান্নাঘরের অন্যতম প্রধান উপকরণটি এখন ভোক্তাদের জন্য “লাক্সারি” পণ্যতে পরিণত হয়েছে।
উত্তরা, বাড্ডা ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহে কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ৪০–৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি পল্লা (৫ কেজি) পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫২০–৫৪০ টাকায়, অর্থাৎ পাইকারি পর্যায়েই কেজি ১০০ টাকার ওপরে।
চাহিদা–সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা
উত্তর বাড্ডা বাজারের পাইকার শরীফুল ইসলাম বলেন, “দুই–তিন দিনের মধ্যেই বস্তাপ্রতি পাইকারি দাম কেজিতে ২৬–২৮ টাকা বেড়েছে। বিক্রি না বাড়িয়ে উপায় নেই।”
অন্য এক ব্যবসায়ী আমিনুল হক জানান, “অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই দাম বাড়ছে। সরবরাহ কম, চাহিদা বেশি—এই চাপেই বাজার অস্থির।”

কৃষক থেকে পাইকার—দোষ কার?
ভোক্তারা বলছেন, বাজার মনিটরিং একেবারেই অকার্যকর। ক্রেতা মায়মুনা আক্তার বলেন, “সব সময় বলা হয় কৃষক দাম পায় না, বিক্রেতার দোষ নেই। তাহলে লাভটা কে নিচ্ছে? সরকার জানে না, জানতেও চায় না।”
অন্যদিকে, পাইকাররা বলছেন তারা বাধ্য হয়েই বাড়তি দামে বিক্রি করছেন, কারণ “প্রতি মণ ৪,০০০ টাকায়” কিনতে হচ্ছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা মজুত করে পরে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ নিচ্ছেন।
উৎপাদনে ঘাটতি ও প্রাকৃতিক প্রভাব
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের শুরু পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম সাধারণত বাড়ে। “এ সময়ে কৃষকদের সংরক্ষিত পেঁয়াজ শেষ হয়ে যায়। নতুন ফসল বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম বেশি থাকবে,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ উইং পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, কৃষকরা ইতোমধ্যে আগাম জাতের মুরিকাটা পেঁয়াজ রোপণ শুরু করেছেন, যা ডিসেম্বরের শুরু বা মাঝামাঝি বাজারে আসবে।

তবে পাবনার সাথিয়া উপজেলার কৃষক আরশাদ মোল্লা বলছেন, অনেকেই এবার চাষ করেননি, কারণ গত বছর ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। “গত বছর মণপ্রতি ৫০০–১,০০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবার দাম বেশি হলেও ডিসেম্বর এলেই দাম অর্ধেকে নেমে আসে,” বলেন তিনি।
তাহলে কেন ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে না?
বাজারের এই সংকটের মধ্যেও এখনও পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা বলছেন, সিদ্ধান্ত আসবে বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, “কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে নতুন পেঁয়াজ দুই সপ্তাহের মধ্যেই বাজারে আসবে। যদি তা হয়, তাহলে আমদানি অনুমতি দেওয়া হবে না।”
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করলেও এর প্রায় ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণে প্রতিবছর ৫–৭ লাখ টন আমদানি করতে হয়।
ভারতীয় বাজারেও চাপে দাম
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পেঁয়াজের দাম এখন অনেক বেশি। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী হিলি স্থলবন্দরে রপ্তানি অনুমোদন না থাকায় আমদানি কার্যত বন্ধ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পাইকার ও আমদানিকারকেরা “অর্থনৈতিক ঝুঁকি” এড়িয়ে আপাতত অপেক্ষা করছেন—দেখতে, ডিসেম্বরের আগেই দেশীয় সরবরাহ পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায়।

আমদানিকারকদের হিসাব: ঝুঁকি বনাম লাভ
পেঁয়াজ আমদানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে পণ্য আনার অনুমতি না থাকলে তারা আগেভাগে অর্ডার দিতে পারছেন না। অনুমতি মিললেও এক থেকে দেড় সপ্তাহ সময় লাগে চালান পৌঁছাতে। এই অবস্থায় যদি ডিসেম্বরের প্রথমেই দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে আসে, তাহলে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রি করে লোকসান গুনতে হবে।
একজন আমদানিকারক বলেন, “গত বছর এমন অবস্থায় আমদানি করেছিলাম, পরে দাম পড়ে গিয়েছিল। এবার তাই কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছে না।”
সামনে কী হতে পারে?
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য বলছে, এক মাসেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম এখনো কিছুটা কম।
সরকারি পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না হলে, বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত বাজারে অস্থিরতা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশে পেঁয়াজ এখন শুধু খাদ্য উপকরণ নয়, বরং অর্থনীতি ও রাজনীতির এক জটিল প্রতীক। ভারত থেকে আমদানির বিলম্ব, দেশীয় উৎপাদনের ঘাটতি ও বাজার কারসাজি—সব মিলিয়ে এই অস্থিরতা ভোক্তাদের কষ্ট বাড়াচ্ছে। তবে ডিসেম্বরের নতুন ফসল বাজারে এলে এই আগুনে দামের ‘ঠাণ্ডা হাওয়া’ বইবে—এমন আশাই এখন সাধারণ মানুষের।
#পেঁয়াজবাজার #বাংলাদেশঅর্থনীতি #আমদানি_সংকট #ভোক্তাঅধিকার #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















