হাজার বছরের বন ও মাটির নিচে লুকানো এক মহাকীর্তি
প্রায় তিন সহস্রাব্দ আগে নির্মিত দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকোর এক বিশাল মায়া স্থাপত্য দীর্ঘদিন অরণ্য ও কৃষিক্ষেতের নিচে লুকিয়ে ছিল। আধুনিক রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি আকাশ থেকে শনাক্ত করা হয় এবং ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে। পাঁচ বছর পর, প্রত্নতত্ত্ববিদরা এর নানান রহস্য উন্মোচন করছেন।
আগুয়াদা ফেনিক্স: মায়া সভ্যতার সূচনালগ্নের নিদর্শন
এই বিশাল কৃত্রিম মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সংযোগকারী রাস্তা, খাল ও নির্মিত পথ রয়েছে, তৈরি হয়েছিল প্রায় ৩০৫০ বছর আগে এবং প্রায় ৩০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়েছিল। “আগুয়াদা ফেনিক্স” নামে পরিচিত এই স্থাপনা প্রাচীন মায়া সভ্যতার প্রাচীনতম ও বৃহত্তম স্থাপত্য—যা টিকাল বা তেওতিহুয়াকানের মতো পরবর্তী শহরগুলোকেও আকারে ছাড়িয়ে গেছে, যদিও এখানে কোনো পাথরের পিরামিড ছিল না।
মহাবিশ্বের প্রতিচ্ছবি
নতুন গবেষণা অনুযায়ী (প্রকাশিত: Science Advances), এই স্থানটি মূলত মহাবিশ্বের প্রতীক হিসেবে নকশা করা হয়েছিল। এখানে একাধিক ক্রস-আকৃতির স্থাপনা রয়েছে, যার কেন্দ্রে একটি ক্রুশাকার গহ্বর এবং তাতে সংরক্ষিত মূল্যবান আনুষ্ঠানিক বস্তু পাওয়া গেছে।

আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ তাকেশি ইনোমাতা বলেন, “এটি যেন মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র মডেল। তারা বিশ্বাস করত যে মহাবিশ্ব ক্রুশাকার বিন্যাসে গঠিত এবং সময়ের ধারাও এই বিন্যাসের সঙ্গে যুক্ত।”
মায়া সভ্যতার সূচনা পর্ব
এই স্থাপনা গড়ে ওঠে মায়া সভ্যতার প্রারম্ভিক যুগে, যা খ্রিষ্টীয় ৪০০ থেকে ৯০০ সালের মধ্যে শিখরে পৌঁছায়। তখন মেক্সিকো ও গুয়াতেমালায় মন্দির, সড়ক, পিরামিড ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ইনোমাতা বলেন, “এর আগে কোনো বড় নির্মাণ কার্যক্রমের প্রমাণ নেই—তারা তখনও সিরামিক ব্যবহার শুরু করেনি।”
আধুনিক প্রযুক্তিতে নতুন আবিষ্কার
গবেষক দলটি মাটির নমুনা পরীক্ষা ও লিডার (Light Detection and Ranging) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এলাকার বিশ্লেষণ চালায়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘন বৃক্ষাবৃত এলাকায় লুকানো প্রাচীন স্থাপনা শনাক্ত করা যায়।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেরোনিকা ভাসকেজ লোপেজ জানান, “মাটি ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি হওয়ায় এটি অনেকাংশে প্রাকৃতিক পাহাড়ের মতো মনে হয়। বর্তমানে এর বেশিরভাগ অংশ কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই মাটি থেকে এটি সহজে বোঝা যায় না।”
এক হাজার মানুষের সমাগমের স্থান

স্থানটির কেন্দ্রে একটি উঁচু চত্বর রয়েছে, যেখানে এক হাজারেরও বেশি মানুষ একত্র হতে পারত। এটি উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমমুখী দুটি দীর্ঘ পথের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল—যা সম্ভবত ধর্মীয় শোভাযাত্রার পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
চত্বরের কেন্দ্রে পাওয়া যায় একটি ক্রুশাকার গহ্বর, যার ভেতরে আরও ছোট একটি গহ্বরে জেড পাথরের আনুষ্ঠানিক বস্তু রাখা ছিল, সেটিও ক্রুশাকারভাবে সাজানো ছিল।
ইনোমাতা জানান, “গহ্বরে বিভিন্ন রঙের পদার্থ ছিল, যা দিক নির্দেশ করে—উত্তরে নীল, পূর্বে সবুজ, দক্ষিণে হলুদ, আর পশ্চিমে লাল শাঁস পাওয়া গেছে।”
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থাপনা
এই স্থাপনার পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ ১৭ অক্টোবর ও ২৪ ফেব্রুয়ারির সূর্যোদয়ের সঙ্গে মিল রয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে মায়া ক্যালেন্ডারের গুরুত্বপূর্ণ দিনে এখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠিত হতো।
ইনোমাতা বলেন, “দুটি তারিখের ব্যবধান ১৩০ দিন—যা ২৬০ দিনের ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের অর্ধেক। এই সময়চক্র এবং দিকনির্দেশ তাদের কাছে মহাজাগতিক গুরুত্ব বহন করত।”
শাসকহীন শ্রমের প্রতীক
গবেষণায় দেখা গেছে, এই স্থাপনায় কোনো রাজা বা শাসকের প্রতিকৃতি বা প্রাসাদের প্রমাণ মেলেনি। ইনোমাতা বলেন, “মায়া সভ্যতার পরবর্তী শহরগুলিতে যেমন শাসক শ্রেণি বা প্রাসাদ ছিল, এখানে তা নেই। বরং সবাই স্বেচ্ছায় একত্র হয়ে এই বিশাল কাজ সম্পন্ন করেছিল।”

নির্মাণে ব্যাপক মানবশ্রম
গবেষকদের অনুমান, এক হাজারেরও বেশি মানুষ কয়েক বছর ধরে মৌসুমি শ্রম দিয়ে এটি নির্মাণ করে। খাল ও পুকুরগুলির মোট আয়তন ছিল ১,৯৩,০০০ ঘনমিটার, যা শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণই থেকে যায়। মূল মঞ্চের আয়তন ৩.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার, যার জন্য প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ কর্মদিবসের শ্রম প্রয়োজন হতো।
সমতা ও সহযোগিতার প্রতীক
ইনোমাতা বলেন, “আমরা সাধারণত মনে করি বড় কিছু করতে গেলে শ্রেণিবিন্যাস জরুরি, কিন্তু এই স্থাপনাটি দেখায় যে মানুষ একত্রিত হয়ে সহযোগিতার মাধ্যমেও মহৎ কাজ সম্পন্ন করতে পারে।”
গবেষকদের প্রতিক্রিয়া
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ স্টিফেন হিউস্টন বলেন, “আগুয়াদা ফেনিক্সে মেসোআমেরিকান সমাজের একটি সাধারণ ধারণা—দিকনির্দেশ ও রঙের ধর্মীয় প্রতীক—প্রাথমিক সময়েই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এটি দেখায় যে বৃহৎ নির্মাণও সমানাধিকারের সমাজে সম্ভব ছিল।”
অন্য এক অধ্যাপক অ্যান্ড্রু শেরার যোগ করেন, “এই মাটির কাজের বিশালতা, এর প্রাচীনতা এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের অনুপস্থিতি এটিকে অনন্য করেছে। বিপুল পরিমাণ শ্রম বিনিয়োগ করা হলেও কোথাও কোনো শাসকের গৌরব প্রকাশ পায়নি। এই সময়কাল মেসোআমেরিকার ইতিহাসে এখনো অজানা অধ্যায়, তাই এই আবিষ্কার একে বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















