ভয়াবহ এক রাত: “উইচ অফ নভেম্বর” এর মুখোমুখি
১৯৭৫ সালের ১০ নভেম্বর। ভয়ঙ্কর তুষারঝড় আর ৩৫ ফুট উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করছিলেন ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট ম্যাকসোরলি ও তার ২৯ জন নাবিক। তার শেষ কথাগুলো ছিল রেডিওতে — “আমরা টিকে আছি।”
মাত্র ১৫ মিনিট পরেই, লেক সুপিরিয়রের উত্তাল ঢেউ ও তুষারঝড়ে ৭২৯ ফুট লম্বা মালবাহী জাহাজ এসএস এডমন্ড ফিটজেরাল্ড ডুবে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় তার পুরো নাবিকদলকে। কোনো বিপদ সংকেত পাঠানোর সুযোগই তারা পাননি।
আজও, কানাডার হোয়াইটফিশ বেতে লেক সুপিরিয়রের ৫০০ ফুট গভীরে তাদের দেহাবশেষ শায়িত আছে। তবু, তাদের স্মৃতি বেঁচে আছে কিংবদন্তি, গান ও স্মারক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
এক ঐতিহাসিক জাহাজ ও তার উত্তরাধিকার
১৯৫৮ সালে চালু হওয়া এডমন্ড ফিটজেরাল্ড ছিল তখনকার সময়ের গ্রেট লেকসের সবচেয়ে বড় জাহাজ। ৭২৯ ফুট দৈর্ঘ্যের এই জাহাজটি ছিল প্রায় দুটি ফুটবল মাঠের সমান লম্বা।
যখন এটি উত্তর মিশিগানের “সু লকস” দিয়ে পার হতো, তখন শত শত মানুষ এটি দেখতে ভিড় জমাত।
ফিটজেরাল্ড ছিল গ্রেট লেকসের শেষ বাণিজ্যিক জাহাজ যা ডুবে যায় — এবং সেই কারণেই এটি আমেরিকার ইতিহাসে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে।
কীভাবে ঘটল সেই দুর্ঘটনা?
এখনও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি, ঠিক কীভাবে জাহাজটি ডুবে গিয়েছিল।
বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে —
- জাহাজটি কোনো পাথুরে স্থানে ধাক্কা খেয়েছিল,
- কার্গো হ্যাচ দিয়ে পানি ঢুকে জাহাজটি ভেতর থেকে ডুবে যায়,
- অথবা ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের আঘাতে কাঠামোগত ত্রুটি দেখা দেয়।
দুটি বড় তদন্ত হয় —
১. যুক্তরাষ্ট্র কোস্টগার্ডের মেরিন বোর্ড (১৯৭৭)
২. ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড (১৯৭৮)।
দুই প্রতিবেদনেই বলা হয়, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় সঠিক কারণ জানা সম্ভব হয়নি। তবে অনুমান করা হয়, কার্গো হ্যাচের ক্ষতির কারণে পানি প্রবেশ করেই জাহাজটি ডুবে যায়।
প্রিয়জন হারানোর বেদনা
২৯ জন নাবিকের মৃত্যু একসঙ্গে শত শত মানুষের জীবনে শোকের ছায়া ফেলেছিল।
গ্রেট লেকস শিপরেক মিউজিয়ামের পরিচালক ব্রুস লিন বলেন,
“ওই জাহাজের প্রত্যেকেরই ঘরে প্রিয়জন ছিল — পিতা, ভাই, স্বামী। তাদের মৃত্যু অসংখ্য পরিবারকে বিধ্বস্ত করে দেয়।”
স্মৃতির ঘণ্টাধ্বনি
প্রতি বছর ১০ নভেম্বর, এডমন্ড ফিটজেরাল্ড স্মরণানুষ্ঠানে এক বিশেষ ঘণ্টা বাজানো হয়।
ঘণ্টাটি ৩০ বার বাজানো হয় —
২৯ বার নাবিকদের স্মরণে,
এবং একবার গ্রেট লেকসে প্রাণ হারানো আরও প্রায় ৩০,০০০ নাবিকের স্মরণে।
১৯৯৫ সালে নিহতদের পরিবারের অনুরোধে, ঘণ্টাটি পানির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়।
মূল ঘণ্টার স্থানে এখন একটি প্রতিরূপ স্থাপন করা আছে, যার গায়ে খোদাই করা আছে সেই ২৯ জন নাবিকের নাম। সেটিই এখন তাদের প্রতীকী কবরফলক।
আধুনিক প্রযুক্তি আর অতীতের শিক্ষা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আজকের উন্নত আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা থাকলে, ফিটজেরাল্ড হয়তো সেদিন বন্দরে থেকেই যাত্রা স্থগিত করত।
১৯৭০-এর দশকে নাবিকরা রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে সীমিত তথ্য পেতেন এবং হাতে আঁকা মানচিত্রে ঝুঁকি অনুমান করতেন।
এখনকার স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, আবহাওয়া বিশ্লেষণ ও রুট ট্র্যাকিং সিস্টেম এমন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
নিষিদ্ধ ডাইভ ও সংরক্ষিত স্মৃতি
১৯৯৫ সালে, পেশাদার ডাইভার টেরেন্স টাইসল এবং মাইক জ্লাটোপলস্কি প্রথমবারের মতো ফিটজেরাল্ডের ধ্বংসাবশেষে পৌঁছান।
লেক সুপিরিয়রের ৫০০ ফুট গভীরে নামতে গিয়ে তারা ঠান্ডা অন্ধকার পানির নিচে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ স্পর্শ করেন।
টাইসল বলেন,
“আমি যখন রেলটি ছুঁয়ে দেখি, মনে হয়েছিল যেন কোনো কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এটি কেবল অভিযান নয়, এক গভীর শ্রদ্ধার মুহূর্ত।”
২০০৬ সালে, কানাডা সরকার ভুক্তভোগীদের পরিবারের অনুরোধে এডমন্ড ফিটজেরাল্ডকে “সংরক্ষিত সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক কবরস্থান” হিসেবে ঘোষণা করে।
অন্টারিও হেরিটেজ আইনের অধীনে এখন সেখানে অনুমতি ছাড়া ডাইভ দেওয়া নিষিদ্ধ, এবং নিয়ম ভাঙলে ১০ লাখ কানাডীয় ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এসএস এডমন্ড ফিটজেরাল্ড এখনো স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষের সাহস, প্রকৃতির নির্মমতা ও অমর স্মৃতির শক্তিকে।
এর গল্প শুধুমাত্র এক জাহাজডুবির ইতিহাস নয় — এটি এক মানবিক উত্তরাধিকার, যা আজও লেক সুপিরিয়রের ঢেউয়ের সঙ্গে বয়ে চলে।
#এডমন্ড_ফিটজেরাল্ড #গ্রেট_লেকস #নৌদুর্ঘটনা #স্মৃতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















