সংস্থাটির হিসাবে, কেবল অক্টোবর মাসেই দেশের নানা স্থান থেকে ৬৬টি অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং একই সময়ে ১৩ জনের হেফাজতে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।৷
এমএসএফ জানিয়েছে. এই ঘটনাগুলো ‘‘জনজীবনে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতাকে প্রতিফলিত করে৷ একই সময়ে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই মরদেহগুলো শনাক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷”
বাংলাদেশের নৌপুলিশের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে নদী থেকে গড়ে ৪৩টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে৷ ২০২৪ সালে এই হার ছিল প্রতি মাসে গড়ে ৩৬৷
কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ইউনূস সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে
নূর খান বলেন, পুলিশ ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা তদন্তের জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘সবগুলো যে হত্যাকাণ্ড সেটাও তো নিশ্চিত না৷ তবে এর মধ্যে কিছু তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে৷”
‘‘শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নয়, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী৷
অক্টোবরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ), কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) সহ ছয়টি আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি যৌথ খোলা চিঠিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে নিরাপত্তা খাত মূলত সংস্কারবিহীনই রয়ে গেছে এবং নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা জবাবদিহিতা এবং সংস্কার প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে না৷”
এইচআরডাব্লিউ-এর এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, সরকারের উচিত ‘নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর’ সঙ্গে কাজ করা যাতে বাংলাদেশিরা ‘বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখে’ এবং ‘ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ এবং মব সহিংসতায় জড়িত হওয়া বন্ধ করে’৷
তরুণ রাজনীতিবিদের মৃত্যু ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
জানুয়ারিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের নেতা তৌহিদুল ইসলামকে কুমিল্লা শহর থেকে ধরে নিয়ে যায় যৌথবাহিনী৷ পরদিন গোমতী নদীর কাছে তাকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় এবং হাসপাতালে নেওয়ার পরই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়৷
ইসলামের মৃত্যুর পর ক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে সরকার স্থানীয় সেনা কমান্ডারকে প্রত্যাহার করে এবং ইসলামের মৃত্যুর তদন্ত শুরুর কথা জানায়৷
কিন্তু এরপর থেকে এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি না হওয়ার কথা জানিয়েছে ভুক্তভোগীর পরিবার৷
ইসলামের ভাই আবুল কালাম আজাদ ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ‘‘এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি, কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ আমাদের মামলাও করতে দেয়া হয়নি৷ পুলিশ একটা এজাহার লিখেছে, তাতে আমাদের সই নিয়েছে৷ আমাদের কোনো কথা শোনা হয়নি৷ কাউকে আসামিও করতে দেয়া হয়নি৷”
পরবর্তীতে ইসলামের দল বিএনপির স্থানীয় নেতারাও এ নিয়ে ‘চুপ থাকতে চাপ দিয়েছেন, হুমকি দিয়েছেন’ বলেও জানিয়েছেন আজাদ৷
‘এটা খুবই দুঃখজনক’
সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রচার বিভাগ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এবং পুলিশের মন্তব্য জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও সংস্থা দুটি তাতে সাড়া দেয়নি৷
তবে ৪ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘নিরাপত্তা বাহিনী বা অন্য কোনও গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত যে-কোনো ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি করা হবে৷”
নূর খান মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এসব বক্তব্য কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে৷
‘‘আসলে আগের সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা যে ভাষ্য প্রচার করতেন, এখনো একই ধরনের ভাষ্য প্রচার করা হয়৷ এটা খুবই দু:খজনক,” বলেন তিনি৷
এই মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, ‘‘সরকার এগুলো পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না৷ এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনায় কাউকে আইনের আওতায় আনা বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে৷”

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনও ‘গভীর উদ্বেগজনক’
শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার তীব্র অবনতি ঘটেছিল৷
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এর বার্ষিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে ১২১তম স্থান থেকে ২০২৪ সালে ১৬৫তম স্থানে নেমে এসেছিল৷ ২০২৫ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, বাংলাদেশ ১৪৯তম অবস্থানে উঠে এসেছে৷ কিন্তু এখনও বাংলাদেশ ‘অত্যন্ত গুরুতর’ বিভাগেই রয়ে গেছে৷
৬ নভেম্বর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক এক আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘‘কেউ কেউ বলেন, এখন নাকি মবের ভয় আছে৷ কিন্তু আমি সেই ভয় দেখতে পাই না৷ যারা সেই সময় দোসর (শেখ হাসিনা বা আওয়ামী শাসনের) ছিল তারা মবের ভয় পাচ্ছেন৷”
কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নয়৷
সিপিজের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিচালক বেহ লি ই ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদের জন্য এখনও গভীর উদ্বেগের বিষয়৷” কিছু সংস্কার করা হলেও, ‘এই সংস্কারগুলো যথেষ্ট নয়’ বলে মনে করেন তিনি৷
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলেও ডিডাব্লিউর অনুরোধে সাড়া দেয়নি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং৷
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে পাস হওয়া সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার৷ হাসিনার আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই আইনের অধীনেই৷ আইনটি কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকসহ অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আইনটির সাম্প্রতিক সংশোধনীগুলোকে ‘ড্রাকোনিয়ান’ বা ‘নির্দয়’ বলে আখ্যা দিয়েছে৷
সিপিজে জানিয়েছে, অন্তত চারজন সাংবাদিক – ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত এবং মোজাম্মেল হক বাবু – এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক রয়েছেন৷ সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠনটি এই মামলাগুলোকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যার অভিযোগ’ হিসাবে বর্ণনা করেছে৷ আরো ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘কথিত গণহত্যার’ অভিযোগে তদন্ত চলছে বলেও জানিয়েছে সংগঠনটি৷
আগস্টে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের পর সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাসহ ১৬ জনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়৷
অক্টোবরে দেয়া এক বিবৃতিতে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের দক্ষিণ এশিয়া প্রধান সেলিয়া মার্সিয়ে ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ’ এর উদাহরণ হিসাবে মঞ্জুরুল আলম পান্নার আটকের বিষয়টি তুলে ধরেছেন৷ মার্সিয়ে আরো অভিযোগ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘সমালোচকদের কণ্ঠস্বর রোধ করার’ জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করছে৷
পান্নাকে দেশটির হাইকোর্ট জামিন দিলেও রাষ্ট্রপক্ষ সেটার বিরোধিতা করে আপিল বিভাগে আবেদন করে। ১০ নভেম্বর আপিল বিভাগও জামিন বহাল রাখায় তার মুক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।