দফায় দফায় বৈঠক করে প্রায় ৪০০ কোটি টাকায় ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেখানে আর মাত্র তিন মাসের মতো সময় আছে, এই সময়ও এসব ক্যামেরা কেনা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় এসব ক্যামেরা কেনার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এখনো এগুলো কেনার বিষয়ে চূড়ান্ত আদেশ না হওয়ায় নির্বাচনের আগে সেটি পুলিশের হাত পৌঁছাবে কি-না সেটি নিয়েও সংশয় রয়েছে।
যদিও, মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, “বডি ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া আগামীকাল বা পরশুর মধ্যেই সম্পন্ন হবে”।
একই প্রশ্নে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “দ্রুতই বডি ক্যামেরা কেনার জন্য আমরা একটা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। দুয়েকদিনের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য চিঠি পাঠানো হবে”।
গত অগাস্টে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল, আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পুলিশের জন্য ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা কেনার পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
কিন্তু গত বুধবার পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন সেই সংখ্যা কমিয়ে ৩৫ হাজার বডি ক্যামেরা কেনার চিন্তা করা হচ্ছে।
একদিকে বডি ক্যামেরার সংখ্যা নিয়েও যেমন ধোঁয়াশা কাজ করছে, এই ক্যামেরা কিনতে কত খরচ হবে সেটি নিয়েও কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি পুলিশ সদর দপ্তর।
যদিও সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছিলেন, ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা কিনতে খরচ হতে পারে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার মতো।

তিনি জানান, ভোট চুরি-কেন্দ্র দখল ঠেকাতে এই বডি ক্যামেরাগুলোতে ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তি। যদি কেউ ছুরি, দা, হকিস্টিকসহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে বিশেষ আলার্ম বা সর্তকতাও দেবে এই বডি ক্যামেরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভিন্ন ভিন্ন মডেলের বডি ক্যামেরা কেনা হবে এবার। যে কারণে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে বডি ক্যামেরার দামের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।
বডি ওর্ন ক্যামেরা কী, কেন ব্যবহার করা হয়?
বডি ওর্ন ক্যামেরা হলো একটি পোর্টেবল ভিডিও ক্যামেরা যা পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের পোশাক বা ইউনিফর্মে যুক্ত করে রাখেন।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এই ক্যামেরার ব্যবহার করে থাকেন।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাব্বির বিবিসি বাংলাকে জানান, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুলিশদের শরীরে লাগানো থাকে বডি ক্যামেরা। পুলিশ কাউকে নিপীড়ন করছে কি না, অনেক সময় তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে কি না দেখতে, সেক্ষেত্রে তাদের বাঁচানোর জন্যও এটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে”।
একই সাথে বিভিন্ন সময় পুলিশ যখন অভিযানে থাকে তখন সেটির ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড রাখতেও বডি ক্যামেরার ব্যবহার করে থাকে পুলিশ।
মি. সাব্বির বলেন, “বডি ক্যামেরায় যে সব ভিডিও ও অডিও যুক্ত থাকে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে কন্ট্রোল সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। কন্ট্রোল সেন্টার থেকে তারা দেখতে পারে এই ক্যামেরা যার কাছে থাকে সেই জায়গার পরিস্থিতি কেমন”।
গত ১৫ বছরের বাংলাদেশের নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ উঠেছে বার বার। গত বছরে অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

নির্বাচনী অনিয়ম বন্ধে এ বছরের অগাস্টে নানা পরিকল্পনা নেয় এই অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় সেসময় সরকার জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তায় কমপক্ষে ৪০ হাজার বডি ওর্ন ক্যামেরা বা বডিক্যাম কিনতে চায় তারা।
নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “নির্বাচনী অনিয়ম বন্ধে বডি ক্যামেরার ব্যবহার হলে সেটি অনেক কাজে দেবে। ভোটের পর অনিয়ম তদন্তেও এটি ব্যবহার করা যাবে”।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের চিন্তা
সারা বিশ্বের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভিন্ন ভিন্ন মডেলের বডি ক্যামেরার ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে কোনোটি অনলাইন, কোনোটি অফলাইন, আবার কোনোটিতে অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তিরও ব্যবহার হয়ে থাকে।
গত অগাস্টে সরকার বডি ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা নেওয়ার পর এ নিয়ে কয়েক দফায় বৈঠকও হয়েছে। সে সব বৈঠকে আগামী নির্বাচনে বডি ক্যামেরা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেরও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে কমিটি করা হয় সেখানে ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
মি. তৈয়্যব বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে তারা যে বডি ক্যামেরার ব্যবহার করতে চান সেগুলোতে তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে চান।
এক্ষেত্রে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে যে সব বডি ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে সেখানে এআই প্রযুক্তির পাশাপাশি ওই ক্যামেরাগুলোতে মেটা ডাটার তথ্যগুলোও থাকবে।
মি. তৈয়্যব বলেন, “যদি কোনো ভোটকেন্দ্রে কোনো সন্ত্রাসী দা, বটি, ছুড়ি, হকিস্টিক এ জাতীয় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে, এই ক্যামেরা দূর থেকে ভিডিও দেখে আগে থেকেই সিগন্যাল বা সকর্তবার্তা বাজাবে। এটি এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করলেই সম্ভব”।
নির্বাচনের সময় বডি ক্যামেরা কেন এআই প্রযুক্তির ব্যবহারে করতে চায় সরকার তার ব্যাখ্যায় তিনি জানান, যদি বডি ক্যামেরায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার না করা যায় তাহলে শুধু ভিডিও করার জন্য এই ক্যামেরার ব্যবহার বাড়তি কোনো সুবিধা দিবে না।
তিনি বলেন, “এআই না থাকলে যা হবে হাজার হাজার ভিডিও পরে কেউ দেখবে না। এটা শুধু নির্বাচন কেন্দ্রিক না। নির্বাচন ও নির্বাচনের পরে পোস্ট ইলেকশন ভায়োলেন্সকে কেন্দ্র করে আমরা এটি ব্যবহার করতে চাই”।

এক্ষেত্রে লাল-কমলা ও সবুজ তিন ধরনের ভোটকেন্দ্রের তালিকা তৈরি করে সেই অনুযায়ী ক্যামেরার ব্যবহার করা হবে।
যে সব কেন্দ্র খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সহিংসতা হওয়ার শঙ্কা বেশি সে সব কেন্দ্রে এক ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। ওই ক্যামেরাগুলো ভিডিও ধারণের পাশাপাশি অনলাইনেও সার্ভারের সাথে যুক্ত থাকবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের কন্ট্রোল রুম থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
আর যেসব কেন্দ্র ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয় কিংবা সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা কম, সে সব কেন্দ্রে সাধারণ বডি ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। যেগুলো শুধু ভিডিও ধারণ করবে এবং নির্বাচনের পরে যদি কোনো প্রয়োজন হয় ওই ক্যামেরার ভিডিওগুলো আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
দাম ও বডি ক্যামেরা কেনা নিয়ে নানা প্রশ্ন
বডি ক্যামেরা যাতে দ্রুত কেনা যায়, সেজন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপির মাধ্যমে কেনার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার।
গত সেপ্টেম্বরে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে সিদ্ধান্তও হয়।
গত ২৩শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে ইউএনডিপির মাধ্যমে কয়েক’শ কোটি টাকায় পুলিশের জন্য ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা কেনা হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়েছিল, দ্রুত সেটি হাতে পাওয়ার জন্যই ইউএনডিপির মাধ্যমে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ইউএনডিপির মাধ্যমে কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।
পুলিশ বলছে, প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে এই ক্যামেরা শুধু নির্বাচনের জন্যই না, ভোট শেষে এটি যেন পুলিশ ব্যবহার করতে পারে সেই উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকি, এখনো কেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এই প্রশ্নে বুধবার পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রথমে আমাদের প্রস্তাবনা ছিল ইউএনডিপি মাধ্যমে কেনার। কিন্তু ইউএনডিপি সেটা পারেনি। যে কারণে এখন এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেই কিনবে। পরে এটা পুলিশের জন্য ব্যবহার করা হবে”।

কবে নাগাদ কত টাকা ব্যয়ে কী পরিমাণ ক্যামেরা কেনা হবে এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এ নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার শিগগিরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে। সেই চিঠি পরই এ নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
“প্রথমে আমাদের ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা কেনার প্রস্তাবনা ছিল। এখন সরকার কতগুলো দেয় সেটা এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত হয়নি”, বলছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক।
এ নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের লজিস্টিক ও টেলিকম বিভাগে যোগাযোগ করা হয়েছে। কথা বলা হয়েছে হেডকোয়ার্টারের মিডিয়া বিভাগের সাথেও। তারা কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।
তবে, সংশ্লিষ্ট শাখার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন প্রথমে ৪০ হাজার কেনার কথা থাকলেও সেটি কমিয়ে ৩৫ হাজার বডি ক্যামেরা কেনার চিন্তা করছে পুলিশ সদর দপ্তর।
এতে সরকারের কত টাকা ব্যয় হবে, সেই সিদ্ধান্তও এখনো তারা চূড়ান্ত করতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা।
সেখানকার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য এখন যে সময় হাতে আছে, সরকারের অনুমোদনের পর এই কেনার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও সেটি নির্বাচনের আগে দেশে পৌঁছানো সম্ভব কি-না সেটি নিয়ে নানা ধোঁয়াশা আছে পুলিশের মধ্যে।
সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তির ক্যামেরার দাম ভিন্ন ভিন্ন। ৩০ হাজার থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত দামেরও বডি ক্যামেরা রয়েছে। এখন কোন প্রযুক্তির কতগুলো ক্যামেরা কেনা হবে সেই সিদ্ধান্তও এখনো হয়নি।
তবে পুলিশ মহাপরিদর্শক মি. আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “কেনা হবে এটা শিওর, তবে কতগুলো কী অনুমোদন হয় সেই অপেক্ষায় আছি আমরা”।
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















