চীনা সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য তার সভ্যতার একেবারে শুরুর দিকে ফিরে যেতে হয়। এই ধারাবাহিক পর্বে দেখা হচ্ছে চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজবংশগুলো কীভাবে তাদের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মাধ্যমে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে।
মঙ্গোলদের শাসনে নতুন যুগের সূচনা
১২৭৯ সাল। ইয়াশানের উপকূলে এক বিপর্যয়কর নৌযুদ্ধে মঙ্গোল শাসক কুবলাই খানের নৌবহর সঙ সাম্রাজ্যের শেষ প্রতিরোধকে পরাস্ত করে। সেনাপতি চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই শুধু একজন বাহ্যিক আক্রমণকারী হিসেবে নিজেকে দেখেননি; তিনি নিজেকে ড্রাগন সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারী এবং বিভক্ত “মধ্য” রাজ্যকে নতুন নিয়মে এক করার নেতা হিসেবে ভাবতেন।
এই বিজয়ের মধ্য দিয়েই শুরু হয় ইউয়ান সাম্রাজ্য (১২৭১-১৩৬৮)। “ইউয়ান” শব্দের অর্থ “উৎপত্তি” বা “প্রথম”, যা নতুন যুগের আভাস দেয়। ইতিহাসে প্রথমবার, সমগ্র চীন এক অ-হান মঙ্গোল খানের অধীনে শাসিত হয়।
বৈশ্বিক সংযোগ ও দাদুর (বেইজিং) বহু-সংস্কৃতির উত্থান
এটি কেবল শাসক পরিবর্তন নয়—চীনা বিশ্বের নতুন বিন্যাস। সিল্ক রোড অভূতপূর্ব বাণিজ্যে ভরে ওঠে, বেইজিং থেকে ভেনিস পর্যন্ত বিস্তৃত সেই পথ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
রাজধানী দাদু—আজকের বেইজিং—তখন আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির কেন্দ্র। পারস্যের জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তিব্বতি ভিক্ষু ও ইউরোপীয় বণিকেরা একই রাস্তায় চলাফেরা করতেন। মার্কো পোলোর বিবরণ ইউরোপকে বিস্ময়ে অভিভূত করেছিল।

ইউয়ান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যের সেতুবন্ধন ও এর প্রশাসনিক উত্তরাধিকার। মঙ্গোল শান্তি (Pax Mongolica) সিল্ক রোডকে নিরাপদ ও কার্যকর করে তোলে, যা পূর্ব-পশ্চিমের প্রযুক্তি, পণ্য ও সংস্কৃতি বিনিময়কে গতিশীল করে। সেই সময়ই কাগজের মুদ্রার বিস্তৃত ব্যবহার শুরু হয়, যা একীভূত আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।
মার্কো পোলো অবাক হয়ে লিখেছিলেন, কীভাবে মহান খান স্বর্ণ-রূপার মুদ্রার বদলে সস্তায় উৎপাদিত কাগজের টাকা ব্যবহার করতেন।
পোশাক: মঙ্গোল ও হান সংস্কৃতির মিশ্রণ
ইউয়ান যুগে পোশাক ছিল বহুজাতিগত রীতির সম্মিলন। মঙ্গোল পোশাক ছিল অভিজাত ও রাজদরবারের মানদণ্ড। জিসুন বা জিসুনফু ছিল আঁটসাঁট হাতার একটি পোশাক, যার নিচের দিকে ভাঁজ থাকত—ঘোড়ায় আরোহনের সুবিধার্থে।
টেরলিগ ও দাহু নামের ছোট হাতার উপরের পোশাকও জনপ্রিয় ছিল। মঙ্গোল নারীরা দীর্ঘ ও ঢিলেঢালা দেল পোশাক এবং উঁচু বোকতা টুপিও পরতেন।
অন্যদিকে, হানদের পোশাক ছিল ঢিলেঢালা ও স্তরযুক্ত। সাধারণ মানুষের মধ্যে রুকুন (শার্ট-ও-স্কার্ট) এবং বানবি (অর্ধহাতা জ্যাকেট) প্রচলিত ছিল।
ইউয়ান যুগে মঙ্গোলরা পশম ও লোমজাত পোশাক থেকে সরে এসে সিল্ক ও উদ্ভিদজাত সূক্ষ্ম বস্ত্র ব্যবহার শুরু করে।
খাদ্যসংস্কৃতি: যাযাবর ও কৃষিনির্ভর রীতির মিলন
ইউয়ান সাম্রাজ্যের খাবার ছিল যাযাবর মঙ্গোল রীতি এবং সাম্রাজ্যের বিস্তৃত বাণিজ্যপথে পাওয়া নতুন উপকরণের সমন্বয়। দুগ্ধজাত খাবার—দই, কুরুত (শুকনো দুধ), মাখন—এবং ছাগল, ভেড়া ও গরুর মাংস ছিল প্রধান খাদ্য।
মঙ্গোল দরবারের চিকিৎসক হু সিহুই চীনা ও মঙ্গোল খাদ্যরীতির সমন্বয়ে ইনশান ঝেংইয়াও নামে স্বাস্থ্যগাইড লেখেন, যেখানে মাংস, দুগ্ধজাত খাদ্য ও তুলসী, এলাচ, জিরার মতো মসলা ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে।
এই সময়ে জোয়ার (সর্গাম) চীনে প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে পরিচিতি পায়—এখনও এটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য।

শিল্প-সংস্কৃতি: সীমাবদ্ধতার মাঝেও সৃজনশীল বিস্ফোরণ
ইউয়ান দরবার অত্যন্ত এলিট শ্রেণিনির্ভর ছিল। তাং যুগ থেকে চালু থাকা প্রশাসনিক পরীক্ষা বাতিল হয়, এবং মঙ্গোলদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত দেখা যায়। ফলে চীনা পণ্ডিতদের উচ্চপদ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়।
এই বঞ্চনা থেকেই সরকারের বাইরে শিল্প-সাহিত্যের নতুন উত্থান ঘটে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওয়েনরেনহুয়া বা পণ্ডিত-চিত্রশৈলীর উত্থান। হতাশ পণ্ডিতরা জনজীবন থেকে সরে গিয়ে কবিতা, ক্যালিগ্রাফি ও ছবির মিলিত শিল্পে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেন।
ইউয়ানের চার মহামহিম শিল্পী—হুয়াং গংওয়াং, নিঝান, উ ঝেন এবং ওয়াং মং—এই ধারাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।
নীল-সাদা চীনামাটির পাত্রের জন্ম
ইউয়ান যুগে পারস্য থেকে কোবাল্ট আমদানির মাধ্যমে নীল-সাদা চীনামাটির উৎপাদন শুরু হয়। পর্তুগালের বিখ্যাত নীল-সাদা আজুলেহোস টাইলস সরাসরি এই চীনা শিল্পের প্রভাব বহন করে।
জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক অগ্রগতি
বিদেশি বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও দূতাবাস ব্যবস্থার উন্নতির ফলে গণিত, চিকিৎসা ও অস্ত্রবিজ্ঞানসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটে। পশ্চিমা ধারণা ও পূর্বের উদ্ভাবনের সমন্বয়ে ইউয়ান যুগ চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় সময়ে পরিণত হয়।
এই ছিল ইউয়ান সাম্রাজ্যের সেই বিস্তৃত ও বৈশ্বিক প্রভাব, যা চীনকে শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও নতুনভাবে বিন্যস্ত করেছিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















