রেকর্ড পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড, তবু মোট নিঃসরণ প্রায় স্থিতিশীল
২০২৫ সালে কয়লা, তেল ও গ্যাস জ্বালিয়ে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমন প্রায় ১.১% বাড়বে—এমনই সর্বশেষ হিসাব প্রকাশ করেছে গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্ট। ব্রাজিলের বেলেম শহরে চলমান জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন COP৩০–এর আড়ালে প্রকাশিত এ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মানবসভ্যতা এ বছর প্রায় ৪২ বিলিয়ন টন CO₂ বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেবে। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন পাউন্ড CO₂ যোগ হওয়ার এই গতি বিজ্ঞানীদের ভাষায় “নির্দয় ও অব্যাহত”। কয়েক বছর ধরে বিশ্ব নেতারা যে বছরটিকে নির্গমন কমার মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, তা আবারও হাতছাড়া হয়েছে।
তবে এই সামগ্রিক ছবির ভেতরে অঞ্চলভেদে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা আছে। উন্নত কয়েকটি অর্থনীতিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়া এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের কারণে নির্গমন কিছুটা কমেছে। প্রায় ৩৫টি দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেই ফসিল জ্বালানি নির্ভরতা কমাতে পেরেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর ফসিল নির্গমন প্রায় ২% বেড়েছে; সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তন ও কিছু বিধিনিষেধ শিথিল হওয়াকে এর পেছনের কারণ বলে অভিহিত করেছেন গবেষকরা। বিমান চলাচল খাতে নির্গমন প্রায় ৭% বেড়েছে, মহামারি পরবর্তী ভ্রমণ বৃদ্ধির প্রভাবে।
বন উজাড় ও অন্যান্য ভূমি ব্যবহজনিত নির্গমন অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। বেশ কয়েকটি দেশে বননিধন কমায় ভূমি থেকে নির্গমন উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে এসেছে, যা ফসিল নির্গমনের সামান্য বৃদ্ধিকে অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের তুলনায় মোট মানবসৃষ্ট নির্গমন প্রায় একই জায়গায় স্থির রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি একদিকে কিছুটা আশার আলো দেখালেও, অন্যদিকে দ্রুত ও ধারাবাহিক হ্রাস ছাড়া ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব।

বাংলা উপশিরোনাম ২ — প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতার ফাঁক
COP৩০–এর আয়োজনে আরেকটি গবেষণা উপস্থাপন করেছে ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার, যেখানে বর্তমান নীতি বাস্তবায়ন ধরে ভবিষ্যতের উষ্ণায়নের চিত্র মডেল করা হয়েছে। তাদের হিসেবে, দেশগুলো যদি এখনকার নীতি পরিবর্তন না করে, তবে শতাব্দীর শেষে পৃথিবী প্রাক–শিল্প যুগের তুলনায় প্রায় ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে। সব দেশ সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতি শতভাগ বাস্তবায়ন করলেও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা নামবে মাত্র ২.২ ডিগ্রিতে। বিজ্ঞানীদের মতে, সাম্প্রতিক কিছু নীতি পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এই পূর্বাভাসকে আরও উদ্বেগজনক করেছে।
বেলেমে আলোচনায় অংশ নেওয়া প্রতিনিধিরা এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। কেউ কেউ বলছেন, মাত্র ১.১% বৃদ্ধিকে ইঙ্গিত হিসেবে দেখা যায় যে নির্গমন শ্লথ হচ্ছে এবং শিগগিরই শীর্ষে পৌঁছে নামতে পারে। অন্যদের মতে, কোনো ধরনের বৃদ্ধি এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তাপপ্রবাহ, জলবায়ুজনিত বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ইতিমধ্যে বহু দেশকে বিপর্যস্ত করছে। আলোচনায় ‘ফসিল ফুয়েল ফেজ–আউট’ বা উৎপাদন পর্যায় থেকেই ধীরে ধীরে তেল–গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বন্ধ করার দাবি জোরালো হচ্ছে।
অর্থায়ন প্রশ্নে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র। উন্নয়নশীল দেশগুলো দেখাচ্ছে, তারা এখনো ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি ও দুর্যোগ মোকাবিলাতেই হিমশিম খাচ্ছে; তার ওপর আবার ব্যয়বহুল পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের চাপ। অনুদান ও ক্ষতিপূরণ তহবিলের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হলে নতুন করে কয়লা ও গ্যাস প্রকল্প বন্ধ রাখা কঠিন হবে বলে তাদের যুক্তি। বিজ্ঞানীরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানো, বন পুনরুদ্ধার—এসব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ইতোমধ্যেই হাতে আছে; এখন দরকার কেবল রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও পর্যাপ্ত অর্থায়নের সুষম সমন্বয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















