প্রকাশকের দীর্ঘ যাত্রা শেষের পথে
বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রকাশক ব্যারি কানিংহাম—যিনি জে.কে. রাউলিংকে চুক্তিবদ্ধ করে ১৯৯৭ সালে প্রথম হ্যারি পটার বইটি প্রকাশ করেছিলেন—আজ অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ৭২ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবছেন তাঁর উত্তরাধিকার, শিশু সাহিত্যকে জীবন্ত রাখার গুরুত্ব এবং গল্প বলার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
শৈশবের বই: এক অসুস্থ বালকের আশ্রয়
পরবর্তী যুদ্ধোত্তর লন্ডনে কানিংহাম ছিলেন অসুস্থ ও ঘরবন্দী শিশু। তবে বই তাঁর কাছে ছিল আশ্রয়। ভ্যানিটি ফেয়ার-এর বেকি শার্প কিংবা ট্রেজার আইল্যান্ড-এর লং জন সিলভার—এই চরিত্রদের জগতে ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন তিনি।
স্কুলে ‘প্রচেষ্টার পুরস্কার’ হিসেবে প্রাপ্ত একটি বই টোকেন ব্যবহার করে তিনি কেনেন তাঁর জীবনের বদলে দেওয়া বই—দ্য হবিট। তিনি বলেন, তিনি অন্তত ২৫ বার বইটি পড়েছেন। কল্পনা, হাস্যরস, গল্প—সবকিছুর মিলন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর মতে, হাস্যরস শিশু সাহিত্যকে আবেগময় করে তোলে, আর সেটাই তাঁকে হ্যারি পটার কেনার সিদ্ধান্তে প্রভাবিত করেছিল।
হ্যারি পটার প্রথম পড়ার মুহূর্ত
১৯৯৪ সালে ব্লুমসবারি চিল্ড্রেনস বুকস নতুন শুরু করেছিল। কানিংহাম তখনো কখনও শিশুদের বই সম্পাদনা করেননি। সেদিন তাঁর টেবিলে এসে পড়ে এক অপ্রস্তুত পান্ডুলিপি—হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন।
বইটি রাতেই পড়েন তিনি। রোয়াল্ড ডালের ছোঁয়া প্রথমেই চোখে পড়ে, কিন্তু যা তাঁকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করে তা হলো বন্ধুত্বের শক্তি এবং অন্যদের জন্য দাঁড়ানোর সাহস। পান্ডুলিপিটি বেশ লম্বা, শিরোনামটিও অদ্ভুত—কিন্তু তিনি দ্বিধা করেননি। পরদিনই প্রায় ২ হাজার পাউন্ডের প্রস্তাব দেন। পরে তিনি বলেন, “হয়তো প্রকাশনা জগতে এটাই সবচেয়ে কার্যকর বিনিয়োগ ছিল।”

বইটি হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো জনপ্রিয় হয়নি; কথোপকথনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ছড়িয়েছে। এক স্কুলে গিয়ে যখন তিনি দেখেন তাঁর মেয়ের সহপাঠী একটি প্রথম সংস্করণ বুকে জড়িয়ে ধরে বলছে, “আমি এই বইটাকে ভালোবাসি”—সেই দৃশ্য তাঁর মনে গেঁথে যায়।
হ্যারি পটার তাঁর জীবন বদলে দেয়। এ সাফল্য তাঁকে শিশু সাহিত্য প্রকাশনা সংস্থা ‘চিকেন হাউস’ গড়ার স্বাধীনতা দেয়।
অবসর—এরপর কী?
ডিসেম্বরের শেষে অবসর নেওয়ার পর কানিংহাম বেশি পড়তে চান—এইবার কাজের জন্য নয়, নিজের আনন্দের জন্য। প্রাপ্তবয়স্কদের বই, ভিন্নধারার বই—সবই পড়তে চান।
এছাড়া তিনি তরুণ লেখকদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে চান এবং পরিবারকে আরও সময় দিতে চান।
একজন ভালো প্রকাশক হতে যা প্রয়োজন
কানিংহাম বিশ্বাস করেন, লেখকদের কী লিখতে হবে তা বলা প্রকাশকের কাজ নয়; বরং যা কাজ করছে না, সেটি বুঝতে সাহায্য করাই প্রকাশকের ভূমিকা।
শিশু সাহিত্যে দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রায়ই লেখকদের জিজ্ঞেস করেন—গল্পটি কি অন্য কারও দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়? উদাহরণস্বরূপ, “মানুষের বদলে কোণের ছোট্ট একটি ইঁদুরের দৃষ্টিকোণ থেকে?”
তার মতে, প্রকাশক এমন প্রশ্ন করবেন যা লেখককে সৃজনশীলতার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এখনকার শিশুদের আমরা অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি, আগের তুলনায় খুব কম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি।

শিশু সাহিত্য কেন আরও শক্তিশালী হলো
হ্যারি পটার বিশ্বব্যাপী শিশু সাহিত্যকে বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি ‘ইয়াং অ্যাডাল্ট’ ধারার ক্রমবৃদ্ধিও বড় ভূমিকা রেখেছে। হাঙ্গার গেমস, মেজ রানার, টোয়াইলাইট—এইসব বই প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদেরকেও আকৃষ্ট করেছে।
কানিংহাম মনে করেন, এসব বই মানুষকে সেই শৈশবের অনুপ্রেরণায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
ক্যারিয়ারের গর্বের মুহূর্ত
হ্যারি পটার নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনের প্রধান অর্জন, তবে তিনি আরও গর্ব করেন নতুন লেখকদের তুলে ধরতে পেরে। অনেক বই খুব বেশি বিক্রি না হলেও পাঠকদের জীবনে শক্ত প্রভাব ফেলতে পারে—এটাকেই তিনি সাফল্য মনে করেন।
শিশুদের বই কেন তাঁকে টানে
পেঙ্গুইনে প্রাপ্তবয়স্কদের বই নিয়ে কাজ করার সময় পাঠক-লেখকের যে সংযোগ তিনি খুঁজে পাননি, তা শিশু সাহিত্যে পেয়েছেন। এখানে লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মধ্যে দলগত কাজ হয়, যা প্রাপ্তবয়স্ক সাহিত্যে কম দেখা যায়।
শিশু সাহিত্য সমাজে কী ভূমিকা রাখে
কানিংহাম মনে করেন, শিশুসাহিত্য এখনো শিশুদের প্রতি সবচেয়ে দায়িত্বশীল মাধ্যম। ক্ষতিকর বিষয়বস্তু তিনি কখনো পাস করান না।
শিশু সাহিত্য সাধারণত আশা শেখায়। রোয়াল্ড ডালের মতো লেখকদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন—সব প্রতিপক্ষকে জয় করা সম্ভব না হলেও, নিজেকে জয় করা যায়।

শিশু সাহিত্যের ভবিষ্যৎ
তিনি বিশ্বাস করেন ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তবে শিশুদের পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তবুও তিনি এখনো ‘বুক হাগার’ শিশুদের দেখেন—যারা বই বুকে চেপে ধরে বলে, “আমি এই বইটাকে ভালোবাসি।” এই শারীরিক, আবেগময় সম্পর্কই তাঁকে আশাবাদী করে।
#BarryCunningham #HarryPotter #ChildrenLiterature # Publishing #Storytelling
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















