০৬:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
দুবাই থেকে শুরু, চার মহাদেশে ‘মাই স্টোরি’ ট্যুরে যাচ্ছেন ইয়ো ইয়ো হানি সিং ধেপা নদী: উত্তরবঙ্গের জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির হৃদস্পন্দন কুষ্টিয়ায় ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া: ভোরের হামলায় বাড়ছে উদ্বেগ নতুন আয়রন-গ্রে পুলিশ ইউনিফর্ম নিয়ে জনমতের মিশ্র প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়ায় আটক বারিশালে বাস চলাচল বন্ধ: সংঘর্ষের পর ১৫০ যানবাহন ভাঙচুর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ট্রলি উল্টে নিহত ১, আহত ২ আবারও বিএনপি নেতা গুলিতে নিহত, এবার লক্ষ্মীপুরে নারায়ণগঞ্জে কৃষক দল নেতার ওপর ছুরিকাঘাত: মাদককারবারীদের হামলার অভিযোগ রাজধানীসহ চার জেলায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বিজিবি মোতায়েন

ডায়াবেটিসের নীরব বিস্তার: কাজের চাপ, চিনি আর স্ক্রিনটাইমের জটিল ফাঁদে বাংলাদেশ

কর্মজীবী জীবনের অদৃশ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি
ডায়াবেটিস এখন আর কেবল “বয়সী মানুষদের” রোগ নয়; শহর থেকে জেলা শহর—সবখানেই কর্মজীবী তরুণ–প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই কাজের চাপ, যানজটে আটকে থাকা সময় আর মোবাইল স্ক্রিনে রাতজাগা জীবনকে “স্বাভাবিক” বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসকদের ভাষায়, এই স্বাভাবিকতা আসলে অদৃশ্য ঝুঁকি—দীর্ঘ সময় বসে থাকা, বারবার মিষ্টি চা–কফি পান করা, ভাত–ভাজিতে ভরপুর প্লেট আর ঘুমহীন রাত মিলিয়ে ধীরে ধীরে শরীরকে ডায়াবেটিসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নগর জীবনের বর্তমান ছন্দে শারীরিক নড়াচড়া কমে গেছে ভয়াবহভাবে। ভোরে বের হয়ে অফিসে দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে, সন্ধ্যায় আবার গাড়ি বা বাসে বসে ফিরতি পথ—এই চক্রে হাঁটার সুযোগ থাকে খুবই কম। অনেকে নাশতা এড়িয়ে যান, দুপুরে তাড়াহুড়ো করে সাদা ভাত আর তেলে ভাজা তরকারি খান। বিকেলের ক্ষুধায় হাত চলে যায় বিস্কুট, চিপস বা ফাস্ট ফুডে। এসব খাবারে ক্যালরি অনেক, পুষ্টি তুলনামূলক কম; ফলে শরীরের ওজন বাড়ে, ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
নারীদের ক্ষেত্রে চিত্র আরও জটিল। অফিস শেষ করে ঘরের কাজ, সন্তান সামলানো, পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা—সব মিলিয়ে নিজের জন্য আলাদা সময় বের করা কঠিন হয়ে যায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ায় অনেক নারী সন্তান ধারণের সময়ও বাড়তি ঝুঁকিতে থাকেন। অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় নিজের চিকিৎসা পেছনে পড়ে থাকে; প্রথমে গুরুত্ব পায় সন্তানের পড়াশোনা, পরিবারের অন্যান্য খরচ। ফলে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে দেরিতে, আর জটিলতার চিকিৎসা হয়ে ওঠে আরও ব্যয়সাপেক্ষ।


অর্থনৈতিক দিকটি তাই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভুগলে কর্মক্ষমতা কমে যায়, অফিসে বারবার ছুটি নিতে হয়, ছোট ব্যবসা হলে দোকান বন্ধ রাখতে হয় কিংবা ক্লায়েন্ট মিটিং বাতিল করতে হয়। এতে মাসের শেষে হিসাব মেলে না; পরীক্ষার রিপোর্ট, ওষুধ আর ডাক্তারের ফি মেটাতে গিয়ে অন্য খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হয় পরিবার। দীর্ঘ মেয়াদে এটি সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে দুর্বল করে।
তবু আশার জায়গা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন হালকা বা মাঝারি গতিতে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস, প্লেটে ভাতের পরিমাণ কমিয়ে ডাল–সবজি বাড়ানো, চিনি মেশানো পানীয় থেকে ধীরে ধীরে সরে আসা—এসব ছোট পরিবর্তনই বড় ফারাক গড়ে দিতে পারে। নিয়মিত রুটিন চেক–আপের মাধ্যমে রক্তে শর্করা, রক্তচাপ আর ওজন পর্যবেক্ষণ করলে ডায়াবেটিসের পথে হাঁটা শরীরকে আগেই থামানো সম্ভব।
এখানে অফিস ও কর্মস্থলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছুটির সময় না কমিয়ে প্রতিদিন কয়েক মিনিট হাঁটার ব্রেক, সিঁড়ি ব্যবহারে উৎসাহ, স্বাস্থ্যকর নাস্তা পরিবেশন ও বছরে একবার ফ্রি বা কম খরচে স্বাস্থ্য পরীক্ষা—এ ধরনের উদ্যোগ কর্মীদের আচরণ বদলাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সহকর্মীরা একসঙ্গে এ ধরনের অভ্যাস গড়ে তুললে ব্যক্তিগত উদ্যম আরও শক্ত হয়।
অবশেষে, ডায়াবেটিসের লড়াই আসলে নিজেদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্তের লড়াই। অতিরিক্ত একচামচ চিনি, রাত ২টা পর্যন্ত সিরিজ দেখা, কিংবা হাঁটার বদলে সবখানে যানবাহনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত—সবই জমে জমে একদিন রোগের রূপ নেয়। তাই “খালি সময় পেলে দেখব” বলে পিছিয়ে না থেকে আজ থেকেই ছোট ছোট পরিবর্তনে শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। শরীরটাকেই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে; কাজ, পরিবার ও স্বপ্ন—সবকিছুর তাগিদই সেই সত্যটা নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

দুবাই থেকে শুরু, চার মহাদেশে ‘মাই স্টোরি’ ট্যুরে যাচ্ছেন ইয়ো ইয়ো হানি সিং

ডায়াবেটিসের নীরব বিস্তার: কাজের চাপ, চিনি আর স্ক্রিনটাইমের জটিল ফাঁদে বাংলাদেশ

০৩:৪৫:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

কর্মজীবী জীবনের অদৃশ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি
ডায়াবেটিস এখন আর কেবল “বয়সী মানুষদের” রোগ নয়; শহর থেকে জেলা শহর—সবখানেই কর্মজীবী তরুণ–প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই কাজের চাপ, যানজটে আটকে থাকা সময় আর মোবাইল স্ক্রিনে রাতজাগা জীবনকে “স্বাভাবিক” বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসকদের ভাষায়, এই স্বাভাবিকতা আসলে অদৃশ্য ঝুঁকি—দীর্ঘ সময় বসে থাকা, বারবার মিষ্টি চা–কফি পান করা, ভাত–ভাজিতে ভরপুর প্লেট আর ঘুমহীন রাত মিলিয়ে ধীরে ধীরে শরীরকে ডায়াবেটিসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নগর জীবনের বর্তমান ছন্দে শারীরিক নড়াচড়া কমে গেছে ভয়াবহভাবে। ভোরে বের হয়ে অফিসে দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে, সন্ধ্যায় আবার গাড়ি বা বাসে বসে ফিরতি পথ—এই চক্রে হাঁটার সুযোগ থাকে খুবই কম। অনেকে নাশতা এড়িয়ে যান, দুপুরে তাড়াহুড়ো করে সাদা ভাত আর তেলে ভাজা তরকারি খান। বিকেলের ক্ষুধায় হাত চলে যায় বিস্কুট, চিপস বা ফাস্ট ফুডে। এসব খাবারে ক্যালরি অনেক, পুষ্টি তুলনামূলক কম; ফলে শরীরের ওজন বাড়ে, ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
নারীদের ক্ষেত্রে চিত্র আরও জটিল। অফিস শেষ করে ঘরের কাজ, সন্তান সামলানো, পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা—সব মিলিয়ে নিজের জন্য আলাদা সময় বের করা কঠিন হয়ে যায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ায় অনেক নারী সন্তান ধারণের সময়ও বাড়তি ঝুঁকিতে থাকেন। অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় নিজের চিকিৎসা পেছনে পড়ে থাকে; প্রথমে গুরুত্ব পায় সন্তানের পড়াশোনা, পরিবারের অন্যান্য খরচ। ফলে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে দেরিতে, আর জটিলতার চিকিৎসা হয়ে ওঠে আরও ব্যয়সাপেক্ষ।


অর্থনৈতিক দিকটি তাই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভুগলে কর্মক্ষমতা কমে যায়, অফিসে বারবার ছুটি নিতে হয়, ছোট ব্যবসা হলে দোকান বন্ধ রাখতে হয় কিংবা ক্লায়েন্ট মিটিং বাতিল করতে হয়। এতে মাসের শেষে হিসাব মেলে না; পরীক্ষার রিপোর্ট, ওষুধ আর ডাক্তারের ফি মেটাতে গিয়ে অন্য খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হয় পরিবার। দীর্ঘ মেয়াদে এটি সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে দুর্বল করে।
তবু আশার জায়গা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন হালকা বা মাঝারি গতিতে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস, প্লেটে ভাতের পরিমাণ কমিয়ে ডাল–সবজি বাড়ানো, চিনি মেশানো পানীয় থেকে ধীরে ধীরে সরে আসা—এসব ছোট পরিবর্তনই বড় ফারাক গড়ে দিতে পারে। নিয়মিত রুটিন চেক–আপের মাধ্যমে রক্তে শর্করা, রক্তচাপ আর ওজন পর্যবেক্ষণ করলে ডায়াবেটিসের পথে হাঁটা শরীরকে আগেই থামানো সম্ভব।
এখানে অফিস ও কর্মস্থলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছুটির সময় না কমিয়ে প্রতিদিন কয়েক মিনিট হাঁটার ব্রেক, সিঁড়ি ব্যবহারে উৎসাহ, স্বাস্থ্যকর নাস্তা পরিবেশন ও বছরে একবার ফ্রি বা কম খরচে স্বাস্থ্য পরীক্ষা—এ ধরনের উদ্যোগ কর্মীদের আচরণ বদলাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সহকর্মীরা একসঙ্গে এ ধরনের অভ্যাস গড়ে তুললে ব্যক্তিগত উদ্যম আরও শক্ত হয়।
অবশেষে, ডায়াবেটিসের লড়াই আসলে নিজেদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্তের লড়াই। অতিরিক্ত একচামচ চিনি, রাত ২টা পর্যন্ত সিরিজ দেখা, কিংবা হাঁটার বদলে সবখানে যানবাহনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত—সবই জমে জমে একদিন রোগের রূপ নেয়। তাই “খালি সময় পেলে দেখব” বলে পিছিয়ে না থেকে আজ থেকেই ছোট ছোট পরিবর্তনে শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। শরীরটাকেই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে; কাজ, পরিবার ও স্বপ্ন—সবকিছুর তাগিদই সেই সত্যটা নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে।