মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপিত কম্পিউটার চিপ এখন বাস্তবতা—এটি দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে অন্ধদের, চলাচল ফিরিয়ে দিচ্ছে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের। আর খুব শিগগিরই এটি বদলে দিতে পারে পুরো বিশ্ব।
ফ্রান্সের উপশহরে বসবাসকারী ৮৭ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষিকা অ্যালিস শারটন বহু বছর ধরে বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (AMD) রোগে ভুগছিলেন। এতে তাঁর দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের মুখ চিনতে পারতেন না, বই পড়তে পারতেন না, রাস্তা চিনে চলাও ছিল অসম্ভব। এই রোগের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই।
তিন বছর আগে তাঁর জীবনে ঘটে বড় পরিবর্তন। একটি পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি প্রাইমা তাঁর হারানো দৃষ্টির কিছুটা ফিরিয়ে দেয়। এখন তিনি প্রতিদিন কিছুটা সময় বই পড়তে পারেন। তাঁর কথায়, “এটি আমার জীবনে নতুন আশার আলো হয়ে এসেছে।”
প্রাইমা প্রযুক্তি: কীভাবে দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসে
সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক বায়োমেডিক্যাল কোম্পানি সায়েন্স কর্পোর তৈরি প্রাইমা প্রযুক্তিতে চোখের রেটিনায় ২ মিমি × ২ মিমি আকারের ক্ষুদ্র একটি চিপ বসানো হয়, যার মধ্যে থাকে ৪০০টি ইলেকট্রোড।
চশমায় লাগানো বিশেষ ক্যামেরা ইনফ্রারেড সিগন্যাল পাঠায় ওই চিপে। এরপর সেই সিগন্যাল অপটিক নার্ভ হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে দৃষ্টিশক্তির অনুভূতি তৈরি করে।
একটি সাম্প্রতিক ক্লিনিক্যাল স্টাডিতে দেখা গেছে, ৩৮ জন রোগীর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ দৃষ্টিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি পেয়েছেন এবং ৮৪ শতাংশ রোগী বাড়িতে অক্ষর, সংখ্যা ও শব্দ পড়তে সক্ষম হয়েছেন।
স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপক ড্যানিয়েল প্যালাঙ্কারের মতে, পরবর্তী প্রজন্মের প্রাইমা চিপে ১০,০০০ পর্যন্ত পিক্সেল থাকতে পারে, যা ২০/২০ দৃষ্টিশক্তির সমতুল্য ফল দিতে সক্ষম হবে।
শুধু চোখ নয়—মস্তিষ্কে সরাসরি চিপ
সায়েন্স কর্পোর পরবর্তী লক্ষ্য সরাসরি মস্তিষ্কে চিপ বসানো। এতে স্ট্রোক, দুর্ঘটনা বা ALS-এ পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ কেবল চিন্তা দিয়ে কম্পিউটার, মোবাইল, হুইলচেয়ার, লাইট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম পরিচালনা করতে পারবেন।
যারা কথা বলতে পারেন না, তাদের চিন্তাকে কম্পিউটারের মাধ্যমে লেখায় রূপান্তর করা যাবে এবং AI-এর সহায়তায় তাদের আগের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করেও কথাগুলো শোনানো সম্ভব হবে।
ম্যাক্স হোডাকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি “বায়োহাইব্রিড” মডেল—যেখানে চিপে স্টেম সেল যুক্ত করা হয় এবং তা মস্তিষ্কের টিস্যুর সঙ্গে মিশে গিয়ে স্নায়ু সংযোগ তৈরি করে।
বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে BCI প্রযুক্তি
ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) প্রযুক্তি এখন আর শুধু চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বজুড়ে ৬৮০টির বেশি কোম্পানি এ নিয়ে কাজ করছে।
২০২২ সালে এর বাজারমূল্য ছিল ১.৭৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সালে তা বেড়ে ৬.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামীদিনে ফায়ারফাইটার, সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মানুষের জীবনেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
নিউরালিংক, ইকো টেকনোলজিসসহ বড় সংস্থাগুলোর ভূমিকা
এলন মাস্ক প্রতিষ্ঠিত নিউরালিংক ইতোমধ্যে ১২ জন রোগীর মস্তিষ্কে চিপ বসিয়েছে। প্রথম রোগী নোল্যান্ড আরবাগ এখন শুধুমাত্র চিন্তা দিয়ে কম্পিউটারের কার্সর নড়াতে পারেন।

ড. এডওয়ার্ড চ্যাংয়ের নেতৃত্বে ইকো টেকনোলজিসের প্রযুক্তি কথা বলতে না পারা রোগীদের চিন্তাকে লেখায় রূপান্তর করতে পারে। এটি কম্পিউটার-জেনারেটেড কণ্ঠে কথা বলতেও সক্ষম এবং মুখের অভিব্যক্তিসহ অ্যাভাটার প্রদর্শন করতে পারে। এমনকি দ্বিভাষিক রোগীর ভাষাও পরিবর্তন করা সম্ভব।
অন্যান্য উন্নয়ন
ব্ল্যাকরক নিউরোটেক ইতোমধ্যে ৫০ জনেরও বেশি রোগীর মস্তিষ্কে চিপ বসিয়েছে।
সিঙ্ক্রন নামের আরেক প্রতিষ্ঠান অস্ত্রোপচার ছাড়াই রক্তনালীর ভেতর দিয়ে চিপ বসানোর প্রযুক্তি তৈরি করেছে, যেখানে মস্তিষ্ক সরাসরি স্পর্শ করার প্রয়োজন হয় না।
ঝুঁকি, সীমাবদ্ধতা ও নতুন চ্যালেঞ্জ
এই প্রযুক্তিতে সংক্রমণ, চিপ বিকল হওয়া বা অতিরিক্ত টিস্যু জমে চিপ অকেজো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
পুরনো “ইউটা অ্যারে” প্রযুক্তি কিছুটা কার্যকর হলেও এর ক্ষমতা সীমিত। নতুন চিপের তারগুলো আরও পাতলা হলেও কিছু ক্ষতি থেকে যায়।
বায়োহাইব্রিড মডেল এখনো পরীক্ষাধীন এবং সায়েন্স কর্পোর গবেষণাগারে বানরের ওপর পরীক্ষা চলছে।
ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতা
বর্তমান প্রাইমা সিস্টেম ব্যবহার করতে চশমার সঙ্গে ভারী ২ পাউন্ডের কম্পিউটার বহন করতে হয়।
কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সংক্রমণ বা অস্বস্তি দেখা দিলে চিপ খুলে ফেলতে হয়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
BCI প্রযুক্তি সামরিক বাহিনী, জরুরি সেবা ও চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটাতে পারে।
কেবল চিন্তা থেকেই সিদ্ধান্ত পাঠানো ও নির্দেশ প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
এমনকি ভবিষ্যতে স্বাভাবিক মানুষও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সার্জারি করে চিপ বসাতে আগ্রহী হতে পারেন।
মূল্য ও নীতিগত প্রশ্ন
প্রাইমা চিপের সম্ভাব্য বাজারমূল্য ১–২ লাখ ডলারের মধ্যে হতে পারে।
FDA-এর অনুমোদন, দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণ—সব মিলিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের আগে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে।
মানুষ ও যন্ত্রের দূরত্ব দ্রুত কমছে। একসময় মানুষ ও মেশিন ছিল আলাদা সত্তা—এখন প্রযুক্তি মানবদেহের অংশ হয়ে উঠছে।
দৃষ্টি ফেরানো বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের চলাচলের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার—সবকিছুই নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলছে। তবে এর সঙ্গে নৈতিক প্রশ্নও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বিশ্ব এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে—
যেখানে মানুষ আংশিকভাবে যন্ত্রে রূপান্তরিত হবে, আর যন্ত্রও ধারণ করবে মানবিক বৈশিষ্ট্য।
#BrainComputerInterface #BCI #Neurotechnology #ScienceReport #FutureTech #MedicalRevolution
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















