কুয়েতের অর্থনীতি ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দুই বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যেখানে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে বার্ষিক ১.৩ শতাংশ। এই উন্নতির পেছনে রয়েছে তেল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অ-তেল খাতের উন্নতি, যা ২.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। উন্নত ব্যবসায়িক আস্থা, বাড়তি বিনিয়োগ ব্যয় এবং সহজতর মুদ্রানীতির কারণে অ-তেল খাত আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এ প্রবণতা ২০২৬ সালে আরও বেগবান হবে।
অ-তেল খাতের উন্নতি ও বিনিয়োগ প্রবাহ
২০২৫ সালে ব্যবসা ও সরকারের বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য গতি এসেছে। করপোরেট ঋণ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬.১ শতাংশ বেড়েছে, আবাসন খাতে বিক্রি বছরের প্রথম নয় মাসে মোট ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং প্রকল্প অনুমোদন ২০২৪ সালের শক্তিশালী ২.৬ বিলিয়ন কুয়েতি দিনারের সমান বা তার চেয়েও বেশি হওয়ার পথে রয়েছে। এসব সূচক ইঙ্গিত করে যে অ-তেল খাতে ২০২৬ সালে প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা ২০২৫ সালের ২.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশি। এই পূর্বাভাস আবার PMI সূচকের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ২০২৫ সালে ৫৩ পয়েন্ট বজায় রেখেছে এবং ধারাবাহিক সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দিয়েছে।
তবে একটি দুর্বল দিক হলো ২০২৫ সালে ভোক্তা ব্যয় হ্রাস পাওয়া, যা কার্ড ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট। বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২৬ সালে এই দুর্বলতা কমতে পারে এবং তা অ-তেল খাতের উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুল্ক বিরোধ এবং ভূরাজনৈতিক সংঘাত বহিঃপরিবেশকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাখলেও কুয়েতের অর্থনীতিতে এসবের সরাসরি প্রভাব খুব সীমিত হওয়ার কথা।
তেল উৎপাদন বাড়ছে
২০২২ সালের পর প্রথমবারের মতো কুয়েতের তেল খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। OPEC-8 দেশগুলো ২০২৩-২৪ সালে স্বেচ্ছায় আরোপ করা দুই ধাপের উৎপাদন কমানোর নীতি শিথিল করার ফলে কুয়েত অতিরিক্ত ২৬৩ হাজার ব্যারেল প্রতিদিন উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছে। যদিও ২০২৬ সালের প্রথম প্রান্তিকে অতিরিক্ত তেল সরবরাহ বৃদ্ধিতে বিরতি দেওয়া হয়েছে, তবুও ২০২৬ সালে কুয়েতের উৎপাদন প্রতিদিন ২.৬ মিলিয়ন ব্যারেল ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা তেল খাতে ২০২৫ সালের ২.৪ শতাংশ থেকে ২০২৬ সালে ৫.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আনতে পারে।

বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ৩.২ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন হওয়ায় কুয়েত OPEC+ গোষ্ঠীর অন্যতম দেশ যা প্রয়োজনে উৎপাদন বাড়িয়ে বৈশ্বিক সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে পারে।
সংস্কারের গতি: অগ্রগতি আছে, আরও বাড়ানো জরুরি
‘ভিশন ২০৩৫: নিউ কুয়েত’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে মুবারক আল-কবীর বন্দর প্রকল্প, আল জউর নর্থ স্বাধীন পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প এবং বিভিন্ন আবাসন শহর নির্মাণ। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সেবাবাবদ বিভিন্ন ফি পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানির ওপর ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়েছে, এবং দীর্ঘদিন আটকে থাকা সরকারি ঋণ আইন অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়া আবাসন অর্থায়ন আইনও চূড়ান্ত হওয়ার পথে।
সরকার স্বীকার করেছে যে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অ-তেল শিল্প খাতের বিকাশ এবং শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সংস্কারের গতি বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে কুয়েতের বিনিয়োগ হার বহু বছর ধরে GCC-এর অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, যা স্থায়ী অ-তেল প্রবৃদ্ধির পথে বাধা। নতুন ঋণ আইন বা সম্ভাব্য দেশীয় বিনিয়োগ তহবিল এই ঘাটতি পূরণে সহায়তা করতে পারে।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে মুদ্রাস্ফীতি ২.৪ শতাংশ ছিল এবং ২০২৬ সালেও এটি একই পর্যায়ে থাকছে। খাদ্য ও পোশাক খাতে মূল্যচাপ কমতে থাকায় এ স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। একইসঙ্গে কুয়েতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধীরে ধীরে সুদের হার কমাচ্ছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের তুলনায় অনেক কম মাত্রায়—এই চক্রে মাত্র ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে হার ৩.৭৫ শতাংশে এনেছে, যেখানে ফেড ১৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছে।
রাজস্ব ঘাটতি অব্যাহত
২০২৫ ও ২০২৬ অর্থবছরে কুয়েতের রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে পারে এবং GDP-এর গড় ৪.৪ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা ২০২৪ সালে ছিল ২.২ শতাংশ। এর প্রধান কারণ হলো ২০২৬ সালে তেলের দাম কমে ব্যারেল প্রতি ৬৫ ডলারে নেমে আসার সম্ভাবনা এবং অ-তেল আয় এখনো সীমিত থাকা। তবে চলমান আর্থিক শৃঙ্খলা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ধীরে বাড়বে—এ সময়কালে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১ শতাংশ ধরা হচ্ছে। সরকার সরকারি খাতে বেতন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সীমিত রাখছে এবং ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিচ্ছে।
উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূলধনী ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। একইসঙ্গে অ-তেল আয় বাড়াতে করপোরেট কর, ফি ও জরিমানা থেকে প্রতি বছর GDP-এর ০.৮ শতাংশ আয় যোগ হচ্ছে। যদিও উৎপাদক কর (excise duty) ও VAT চালু করার সিদ্ধান্ত এখনো অপেক্ষমাণ, তা কার্যকর হলে GDP-এর অতিরিক্ত ২.৪ শতাংশ আয় হতে পারে।
নতুন ঋণ আইন কার্যকর হওয়ায় সরকারের আর্থিক চাপ কমেছে। ২০২৫ সালে ইতোমধ্যে ৫.৫ বিলিয়ন কুয়েতি দিনারের সরকারি ঋণ ইস্যু হয়েছে, যার মধ্যে একটি ইউরোবন্ড ছিল অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন, যার পরিমাণ ১১.৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছায়। এই ঋণ ইস্যু আগামী দুই বছরের ঘাটতি মেটানোর জন্য যথেষ্ট। যদিও সরকারি ঋণ GDP-এর ২.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এখনো খুব কম।

সামনে ঝুঁকি ও সম্ভাবনা
অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে সম্ভাব্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তেলের দাম কমে যাওয়া, আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বলতা, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুল্ক উত্তেজনার সঙ্গেও সম্পর্কিত হতে পারে। অন্যদিকে, ইতিবাচক সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে দ্রুততর সংস্কার কার্যক্রম এবং বিশেষ করে আসন্ন আবাসন অর্থায়ন আইন, যা ক্রেডিট চাহিদা এবং আবাসন খাতকে আরও সক্রিয় করবে। একইসঙ্গে সরকারি বিনিয়োগের হার বাড়লে কুয়েতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশের ক্রেডিট রেটিং উন্নতির সুযোগ তৈরি হবে।
সব মিলিয়ে ২০২৬ সাল কুয়েতের জন্য আরও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বছর হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তেল ও অ-তেল উভয় খাতে উন্নতি, সংস্কার কার্যক্রমে গতি, বিনিয়োগ বৃদ্ধির ধারা এবং আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী হওয়ার ফলে দেশটি সামনের বছরগুলোতে আরও স্থিতিশীল ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারে।
#Kuwait_Economy #Kuwait_2026 #MiddleEast_Economy #Oil_and_NonOil_Sectors #GCC_Economic_Outlook
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















