টিনা ব্রাউন—১৯৮০ ও ১৯৯০–এর দশকের মার্কিন মিডিয়া জগতের এক প্রভাবশালী মুখ। ভ্যানিটি ফেয়ার–এর তরুণ সম্পাদক হিসেবে তিনি তখনকার সাংবাদিকতাকে নতুন ধারায় নিয়ে যান—হলিউডের গসিপ, রাজনীতি, যুদ্ধ ও উচ্চবিত্ত সমাজের গল্প একসঙ্গে তুলে ধরা ছিল তাঁর স্বকীয়তা। পরে তিনি দ্য নিউ ইয়র্কার–এর প্রথম নারী সম্পাদক হন, যদিও পরে হার্ভে ওয়াইনস্টাইনের সঙ্গে ব্যর্থ ‘টক’ ম্যাগাজিনের কারণে সেই সময়কে এখন তিনি ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পর তিনি ২০০৮ সালে দ্য ডেইলি বিস্ট চালু করেন এবং রাজপরিবার নিয়ে বই লেখেন। বর্তমানে ৭১ বছর বয়সে তিনি সাবস্ট্যাকে নিজের তীক্ষ্ণ, ব্যঙ্গাত্মক ও রসালো নিউজলেটার ‘ফ্রেশ হেল’ লিখে আবার আলোচনায় আছেন।
টিনা ব্রাউনের নতুন স্বাধীনতা
টিনা ব্রাউন বলেন, এখন তিনি লিখতে গিয়ে কোনো সংযমের প্রয়োজন বোধ করেন না। বিজ্ঞাপনদাতা, পরিচিতজন বা কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ—কোনোটাই তাঁকে আটকে রাখে না। তাই তিনি এখন তাঁর লেখায় আরও স্বাধীন। এভাবেই তিনি মার্ক জাকারবার্গকে “মেটার পিছলে যাওয়া সালামান্ডার”, প্রিন্স হ্যারিকে “অভিমানী জিঞ্জার”, আর লরেন সানচেজকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে বিশ্বের চতুর্থ ধনী মানুষকে পাওয়া যেন “জেনেটিকালি বদলে দেওয়া আঙুরের মতো সবসময় প্রদর্শিত বক্ষ” ছাড়া সম্ভব নয়। তাঁর ভাষায়, “এখন আমাকে আর কাউকে খুশি রাখতে হয় না—তাই যা ইচ্ছে লিখতে পারি।”
সাংবাদিকতার সোনালি সময়
তিনি তাঁর শুরু–দুর্গত দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, তখন কাজ ছিল অনেক বেশি সৃজনশীল ও আনন্দময়। আজকের সাংবাদিকতা বরং চাপ, প্ল্যাটফর্ম সংকট আর অর্থের উদ্বেগে জর্জরিত। তরুণরা যখন তাঁকে প্রশ্ন করে—সাংবাদিকতা শিখতে কী করা উচিত—তখন তিনি প্রায়ই বলেন, “ভারতে যাও।” তাঁর ব্যাখ্যা—ভারতের সাহিত্য ও সাংবাদিকতা এখনো জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। যদিও তিনি স্বীকার করেন, এই উত্তর শুনে তরুণরা খুব খুশি হয় না।

এপস্টিন–ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে স্মৃতিচারণ
জেফ্রি এপস্টিন ও ঘিসলেইন ম্যাক্সওয়েলকে সামাজিকভাবে চিনতেন টিনা ব্রাউন। তিনি বলেন, তখন তাদের সম্পর্ক বোঝা সম্ভব ছিল না, কারণ সামাজিক অনুষ্ঠানে কখনোই তাদের একসঙ্গে দেখা যেত না। ঘিসলেইন সম্পর্কে তিনি বলেন, শৈশবে তিনিই প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার ছিলেন। রবার্ট ম্যাক্সওয়েল এতটাই কঠোর ছিলেন যে ঘিসলেইন ছোটবেলায় বন্ধুকে দেখিয়েছিলেন—চুলের ব্রাশসহ কয়েকটি জিনিস সাজানো আছে, কারণ তাঁর বাবা বলতেন, “আজ কোনটা দিয়ে তোমাকে মারব, তুমি বেছে নাও।” টিনার মতে, এপস্টিনকে খুশি করার জন্যই ঘিসলেইন পরবর্তীতে তরুণীদের শোষণের কাজে যুক্ত হন। কিন্তু সামাজিক পরিবেশে তাঁকে দেখে তা কখনোই বোঝা যেত না। টিনা মনে করেন, ঘিসলেইনের দীর্ঘ কারাদণ্ড হওয়া উচিত, তবে আশঙ্কা করেন—ডোনাল্ড ট্রাম্প ভবিষ্যতে ক্ষমতা ছাড়ার আগে তাঁকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।
#MeToo আন্দোলনের বদলে যাওয়া সময়
দশকেরও বেশি আগে দ্য ডেইলি বিস্ট–এ এপস্টিন নিয়ে প্রথম জাতীয় ধারাবাহিক প্রকাশ করেন টিনা ব্রাউন। কিন্তু তখন সেই খবর তেমন সাড়া ফেলে না। তাঁর ভাষায়—এপস্টিন তখন ছিল “ধনীদের আড্ডার এক অখ্যাত ব্যক্তি।” #MeToo আন্দোলনের পর মানুষ শক্তিশালী পুরুষদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে, ফলে এপস্টিনের কাহিনি নতুনভাবে সামনে আসে।
রাজপরিবার: চিরন্তন মানবিক নাটক
টিনা ব্রাউন রাজপরিবার নিয়ে বিশেষ আগ্রহী। তাঁর মতে, রাজপরিবার নিয়ে লিখতে গেলে শুধুই রাজনীতি নয়, বরং ব্রিটিশ শ্রেণিকাঠামো, খ্যাতি সংস্কৃতি এবং মানুষের ব্যক্তিগত আনন্দ–বেদনার গল্পও উঠে আসে। তিনি বলেন, “ওরা ঠিক আমাদের মতোই অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, কিন্তু হাজার বছরের পুরোনো একটি শাসন ব্যবস্থার খাঁচার মধ্যে।”
প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কল সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল কঠোর। তিনি বলেন, মেগান পেশাগতভাবে বারবার ভুল করছেন, আর হ্যারি খুব বুদ্ধিমান নন। হ্যারি ভেবেছিলেন মেগান তাঁর পথপ্রদর্শক হবেন, কিন্তু দেখা গেল মেগানই ভুল সিদ্ধান্তের পর ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এখন তারা প্রায় সব জায়গায় অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। টিনা বলেন, “হ্যারি রাজপুত্র হিসেবেই সবচেয়ে ভালো করতেন—মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ দারুণ। এখন তিনি শুধু পিআর অনুষ্ঠানে যোগ দেন, আর মেগান তাঁর নতুন রান্নার প্রকল্পে ব্যস্ত।”

আন্না উইনটুরের উত্তরাধিকার
ভোগ সম্পাদক আন্না উইনটুর বিদায় নিচ্ছেন। টিনা ব্রাউন বলেন, উইনটুর শুধু ম্যাগাজিন নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু কন্ডে ন্যাস্টের সেই সোনালি যুগ এখন নেই—সবকিছু কর্পোরেট চাপে বদলে গেছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে টিনা বলেন, দ্য নিউ ইয়র্কার ছাড়াটা ছিল তাঁর ভুল, কিন্তু তাঁর সৃজনশীল অস্থিরতা তাঁকে সবসময় নতুন জায়গা খুঁজতে বাধ্য করেছে।
ধনীদের সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ
সাংবাদিকতায় অতি ধনীদের প্রভাব বিষয়ে তিনি ক্ষুব্ধ। তাঁর মতে, তারা মনে করে অর্থ থাকলেই সব বিষয়ে জ্ঞান থাকবে। কিন্তু তারা সাংবাদিকতাকে সম্মান করে না। এলএ টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, প্যারামাউন্ট—সব জায়গাতেই ধনী মালিকানার কারণে উত্তেজনা বাড়ছে।
নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মমদানি
টিনা ব্রাউন বলেন, নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মমদানি ধনকুবের শ্রেণিকে আতঙ্কিত করেছেন, আর এটি সাধারণ মানুষের জন্য ভালো খবর। বহু মানুষ বহু বছর ধরে ধনীদের আধিপত্যে নিস্তব্ধ হয়ে ছিলেন। মমদানি দেখিয়েছেন, অর্থ সবসময় জয়ী হয় না—লড়াই করলে ধনীদের প্রভাবও হারানো যায়। টিনার মতে, “আপনি তাঁর ভাবনার সঙ্গে একমত না হলেও এই বিজয় গুরুত্বপূর্ণ। আমি এতে খুশি।”
#টিনা_ব্রাউন #সাংবাদিকতা #মার্কিন_মিডিয়া #রাজপরিবার #মেগান_মার্কল #হ্যারি #আন্না_উইনটুর #জোহরান_মমদানি #MeToo
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















