ভিয়েনার আল্পার্টিনা মিউজিয়ামের একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার লিসেট মডেলের সাদা-কালো অসাধারণ ছবিগুলো এখন দেখা যাচ্ছে। নিউইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো থেকে শুরু করে নেভাদার রেনো—সব জায়গার দৃশ্য যেন ইউরোপের মাঝেই হঠাৎ আমেরিকাকে হাজির করেছে। দ্বিতীয় তলার একটি গ্যালারিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে কঠোর মুখের মানুষজনের হাঁটাচলা, ফেডারাল হলের সামনে আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের মূর্তির নিচে তাদের গতিবিধি, আর পাশের কক্ষে লোয়ার ইস্ট সাইডের হতাশ ভিক্ষুকদের মুখ। রেনো শহরের বারে ও জুয়া খেলার গলিতেও দেখা যায় ফাঁকা চাহনির নারী এবং শিকার খুঁজতে থাকা পুরুষদের জীবনচিত্র।
স্ট্রিট ফটোগ্রাফিতে মডেলের উত্তরাধিকার
লিসেট মডেল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফটোগ্রাফারদের একজন। ১৯৪০ এবং ৫০-এর দশকে তোলা তার অকপট, কখনও নির্মম প্রতিকৃতিগুলো স্ট্রিট ফটোগ্রাফির একটি নতুন ধারা তৈরি করে। মানুষকে অজান্তে ধরে ফেলা, ক্যামেরা খুব কাছ থেকে ব্যবহার করা, অথবা ছবিকে এমনভাবে ক্রপ করা যাতে প্রতিটি ভঙ্গি, ত্রুটি বা পোশাকের অদ্ভুত দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে—মডেলের এসব কৌশল মানুষের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে তাদের আসল রূপ তুলে ধরত। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, “বিষয়টি যখন তোমাকে পেটে ধাক্কা মেরে যায়, তখনই ছবি তুলবে।” তার ছাত্রদের মধ্যে ল্যারি ফিঙ্ক ও ডায়ান আরবাস বিশেষভাবে পরিচিত।
মডেলের শেকড় ভিয়েনায়
যদিও মডেল ১৯৩৮ সালে ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান এবং ভিয়েনায় ছবি তোলেননি, তবুও তার শিল্পচেতনা পুরোপুরি ভিয়েনাতেই গড়ে উঠেছিল। প্রদর্শনীর কিউরেটর ওয়াল্টার মোজারের মতে, মডেলের কাজে দেখা যায় এক্সপ্রেশনিজম, স্যুররিয়ালিজম, দেহের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সামাজিক মন্তব্যকে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। তার মতে, মডেল নিখুঁতভাবে ইউরোপীয় শিল্পমনের বহিঃপ্রকাশ।

ভিয়েনার শিল্প ও চিন্তায় বেড়ে ওঠা
১৯০১ সালে ভিয়েনার অষ্টম জেলায় একটি সমৃদ্ধ ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া মডেলের শৈশব কাটে গর্ভনেস, পরিচারিকা ও ব্যক্তিগত শিক্ষকের পরিবেশে। তখন ভিয়েনা ছিল শিল্প-বিপ্লবের কেন্দ্র। এ সময় এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা যেমন এগন শিলে ও অস্কার কোকোশকা মানুষের শরীরকে বিকৃত, যন্ত্রণাময় পোর্ট্রেটে তুলে ধরছিলেন, তেমনি সুরকার আর্নল্ড শোয়নবার্গ ও তার শিষ্যরা সুর ও স্বরের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে দিচ্ছিলেন। একই সময়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষের অবচেতনের গভীরে ডুব দিচ্ছিলেন। মডেলের বাবা ফ্রয়েডের কাছে চিকিৎসা নিতেন, মডেল শিলে ও কোকোশকার শিল্পকর্ম চিনতেন, আর সবচেয়ে বড় কথা—তিনি নিজে শোয়নবার্গের ছাত্র ছিলেন। শোয়নবার্গ কেন্দ্রের আর্কাইভে এখনো তার নামসহ ১৯১৯ সালের কম্পোজিশন ক্লাসের নথি সংরক্ষিত আছে।
শিক্ষক শোয়নবার্গের প্রভাব
শোয়নবার্গ ছিলেন আত্মশিক্ষার প্রবক্তা। তিনি মডেলকে শেখাতেন অভিজ্ঞতা থেকে নিজের মতো করে কাজ শিখতে। আর্কাইভিস্ট তেরেসে মুকজেনেদারের মতে, শোয়নবার্গ নিজেও নিজে শেখা মানুষ ছিলেন এবং তার প্রভাবে মডেলও নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন। কিউরেটর মোজারের মতে, শোয়নবার্গের সংগীতের বেসুরো, অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিক মডেলের ছবিতেও স্পষ্ট—যেখানে বাস্তবতার অস্বস্তিকর দিকগুলো তীক্ষ্ণভাবে ফুটে ওঠে।
ফ্রান্সে শিল্পজীবনের শুরু
১৯২৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর মডেল পরিবারসহ ফ্রান্সে চলে যান। সেখানে পরিচয় হয় শিল্পী এভসা মডেলের সঙ্গে। এভসার উৎসাহে তিনি ৩০-এর দশকের শুরুতে ফটোগ্রাফি শেখেন। ১৯৩৪ সালে তিনি নিস শহরের সমুদ্রতটে ধনী মানুষের ব্যঙ্গাত্মক ছবি তোলেন, যা তার স্বকীয় শৈলীকে স্পষ্ট করে। কয়েক বছরের মধ্যেই লিসেট ও এভসা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। হার্পার’স বাজার এবং নিউইয়র্কের মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম দ্রুতই তার কাজের স্বাতন্ত্র্য দেখে মুগ্ধ হয়।
আমেরিকান ছবিতে ইউরোপীয় প্রভাব
ভিয়েনায় প্রদর্শনীতে তার ছবিগুলোকে নতুনভাবে দেখা যায়। আমেরিকার বাস্তবতাকে তুলে ধরলেও সেখানে স্পষ্ট লক্ষ করা যায় ইউরোপে শেখা শিল্পধারা। তার ছবিতে রয়েছে স্যুররিয়ালিজমের টানাপোড়েন, এক্সপ্রেশনিজমের দেহবীক্ষা আর রাস্তাকে নাট্যমঞ্চের মতো দেখার প্রবণতা। ম্যানহাটনে তোলা তার ‘রিফ্লেকশন’ সিরিজে কাঁচের দেয়ালে ভবন ও মানুষের ছায়া মিশে এক ধরনের জটিল চিত্র তৈরি করে, যা নির্মাণবাদী শিল্পশৈলীর সঙ্গে মিলে যায়।
শহরকে দেখার তার দৃষ্টিভঙ্গি
মডেলের শহর দেখার ধরন ছিল দ্বৈত। তিনি শহরের গতিবিধিতে মুগ্ধ হতেন, কিন্তু একই সঙ্গে সমালোচনামূলক দূরত্ব বজায় রাখতেন। আল্পার্টিনার পরিচালক রালফ গ্লেইস মনে করেন, মডেল মানুষের বাইরের স্তর ভেদ করে তাদের অন্তরের জগৎ দেখতে পেতেন এবং ‘কদর্যতা’কে কখনও ভয় পেতেন না।
মিউজিয়ামের নতুন পরিবর্তন
আল্পার্টিনা আগামী ২৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের প্রদর্শনীতে নারী শিল্পীদের গুরুত্ব দিচ্ছে। জেনি স্যাভিল, ব্রিগিটে কোয়ান্ৎস ও জিটকা হান্জলোভার প্রদর্শনীর পর এবার দেখা যাচ্ছে জাপানজন্মা শিল্পী লেইকো ইকেমুরার প্রথম একক প্রদর্শনী। পরিচালক গ্লেইসের মতে, পুরো কর্মসূচিই নতুন আবিষ্কারকে ঘিরে—দর্শকদের এমন কিছু দেখানো যা তারা হয়তো আশা করেন না, কিন্তু নতুন অভিজ্ঞতা দেয়।
জ্যাজ দুনিয়ার মডেল
প্রদর্শনীর শেষ ঘরে রয়েছে ১৯৫০-এর দশকের জ্যাজ শিল্পীদের প্রতিকৃতি—বিলি হলিডে, বাজ পাওয়েল, এলা ফিটজেরাল্ড এবং লুই আর্মস্ট্রং। আগের কঠোর স্ট্রিট ফটোগ্রাফির তুলনায় এই ছবিগুলো অনেক বেশি মৃদু, প্রাণবন্ত ও আনন্দময়। কিউরেটর মোজারের মতে, শোয়নবার্গের মতো কঠিন সংগীতশিক্ষকের প্রভাব নিয়েও মডেল জ্যাজ সঙ্গীতের প্রগতিশীল ধারার সঙ্গে এক ধরনের আত্মীয়তা খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ছবিতে সংগীতকে ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, কিন্তু মডেল তা অনায়াসেই করে দেখিয়েছেন।
#LisetteModel #ViennaArt #StreetPhotography #AmericanPhotography #PhotographyExhibition
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















