প্রাণঘাতী এক মার্কিন হামলায় নিহত কলম্বিয়ান জেলে আলেহান্দ্রো কাররানসার মৃত্যুকে ঘিরে লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। পরিবারের দাবি, তিনি ছিলেন একজন সাধারণ জেলে; বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ধ্বংস করা নৌকাগুলোতে ছিল মাদক। এই বিতর্ক এখন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও বড় চাপ সৃষ্টি করেছে।
জীবনের শেষ ফোনকল
সেপ্টেম্বরে এক দুপুরে আলেহান্দ্রো কাররানসা তার কিশোরী মেয়েকে ফোন করে জানান—তিনি মাছ ধরতে সমুদ্রে যাচ্ছেন, কয়েক দিনের মধ্যে ফিরবেন। কিন্তু তিনি আর কখনও বাড়ি ফেরেননি। ১৫ সেপ্টেম্বর, তার যাত্রার পরদিন, পরিবার ও সহকর্মী জেলেদের দাবি—মার্কিন সামরিক হামলায় সমুদ্রে তার নৌকাটি ধ্বংস হয় এবং সেখানেই তিনি নিহত হন।
১৪ বছর বয়সী কন্যা শেইলা কাররানসা বলেন, “আমি কখনো ভাবিনি, বাবা এভাবে মারা যাবেন।” তিনি তার ফোনে বাবার ছবি দেখে অশ্রু সামলানোর চেষ্টা করছিলেন।
মার্কিন হামলা নিয়ে তীব্র বিতর্ক
সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২১টি মার্কিন হামলায় ৮৩ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এসব নৌকায় ছিল বিপুল পরিমাণ মাদক, যা মার্কিন সমাজে হাজারো মৃত্যুর কারণ। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বহু আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন—এভাবে সন্দেহভাজনদের হত্যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন।
ট্রিনিদাদ ও টোবাগো উপকূলে ইতিমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত লাশ ভেসে উঠছে। এখন পর্যন্ত যেসব দু’জন বেঁচে ফিরতে পেরেছেন, তারা ভেনেজুয়েলার নয়—একজন কলম্বিয়ান, একজন ইকুয়েডরীয়।
কলম্বিয়া–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপোড়েন
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো এই হামলাকে “খুন” বলে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর ভাষায় অভিযুক্ত করেছেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পেত্রো ও তার পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং কলম্বিয়ার জন্য নির্ধারিত সহায়তা কমানোর ঘোষণা দেন। উত্তরে কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় স্থগিত করেছে।
মার্কিন প্রশাসন দাবি করছে, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো একটি ড্রাগ কার্টেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং লাতিন আমেরিকায় এই অভূতপূর্ব সামরিক উপস্থিতির লক্ষ্য তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। তবে হামলার প্রমাণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র কিছু গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং ভিডিও ফুটেজের অংশবিশেষ প্রকাশ করেছে।
কাররানসা কি মাদক পরিবহনে জড়িত ছিলেন?
পরিবার ও সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ৪২ বছর বয়সী কাররানসা সান্তা মার্তার উপকূলে দীর্ঘদিন ধরে মাছ ধরতেন। মাঝে মাঝে অন্যের নৌকা চালিয়ে আয়ের ব্যবস্থা করতেন। এতে সম্ভাবনা থাকে—যে নৌকায় তিনি ছিলেন, তা তার অজানায় কোনো অবৈধ পণ্য বহন করছিল। তবে কাতেরিনে হার্নান্দেস—কাররানসার তিন সন্তানের মা—এ দাবি সোজাসাপ্টা অস্বীকার করেন।
তার ভাষায়, “আলেহান্দ্রোর ভেনেজুয়েলার সাথে কোনো সম্পর্কই ছিল না। সারাজীবন তিনি এখানেই ছিলেন। যদি তিনি সত্যিই কোনো বড় মাদককারবারি হতেন, তবে আমরা দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতাম কেন?”
পেত্রো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কাররানসার মতো উপকূলীয় অনেক দরিদ্র মানুষ বেকারত্বের কারণে কখনো সখনো মাদক পরিবহনের কাজে জড়িয়ে যেতে পারে। তবে এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণের কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় এখন আর নেই।
দারিদ্র্য, শোক আর অনিশ্চয়তা
কাররানসার পরিবার এখন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কয়েক বছর আগে আলাদা হলেও, হার্নান্দেস জানান—কাররানসা সবসময় তাদের পাশে ছিলেন এবং তার সামান্য আয়ে পরিবারের খাবারের যোগান দিতেন। এখন তিনি ও তিন সন্তান সান্তা মার্তার গাইরা এলাকার মায়ের ছোট্ট বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
আইনি লড়াই শুরু
কাররানসার পরিবার মার্কিন আইনজীবী ড্যান কোভালিককে নিয়োগ করেছে। তিনি বলছেন, এমনকি কেউ মাদক পরিবহনের সন্দেহভাজন হলেও তাকে আটক করা উচিত—হত্যা নয়।
কোভালিক বলেন, “এটি দুই কারণে গুরুত্বপূর্ণ—এক, পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রাখে। দুই, আমরা চাই এই মামলা ভবিষ্যতে এমন হত্যাকাণ্ড রোধ করুক। এটা সরাসরি হত্যার শামিল এবং আইনের শাসন ধ্বংস করছে।”
হোয়াইট হাউস অবশ্য এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেছে—১৫ সেপ্টেম্বর যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা ছিল “নিশ্চিত নার্কো-টেররিস্ট”।
পরিবারের আর্তি: “আমরা ন্যায় চাই”
কাররানসার পরিবার বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যাখ্যা তাদের প্রিয়জনের স্মৃতিকে অপমান করছে। তাদের দাবি শুধু একটাই—একটি সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচার।
#লাতিন_আমেরিকা #যুক্তরাষ্ট্র #কলম্বিয়া সান্তা_#মার্তা #মার্কিন_হামলা #মাদক_যুদ্ধ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















